নীলাক্ষি তীরের আখ্যান ‘উজানবাঁশি’

মিথ বা লোকপুরাণকে আমি কথাসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান বলে মনে করি। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে এত এত মিথ ছড়িয়ে আছে যে, কখনো কখনো মনে হয় গোটা দেশটাই একটা মিথের কূপ। মিথের সঙ্গে এখানকার মানুষের বসবাস। তারা মিথ সৃষ্টি করে, মিথ যাপন করেন, মিথে আনন্দ লাভ করে, মিথে শাসিতও হয়। বাংলায় যত মিথ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, প্রত্যেকটি দিয়ে একেকটি উপন্যাস রচনা সম্ভব, গল্প রচনা সম্ভব। আমাদের ঔপন্যাসিকরা যে তাঁদের উপন্যাসে মিথের ব্যবহার করেননি, তা নয়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’য় দেখি মিথের সফল ব্যবহার। কাৎলাহার বিলের ধারে ঘন জঙ্গল সাফ করে বাঘের ঘাড়ে জোয়াল চাপিয়ে আবাদ শুরু করার দিনের এক বিকেলবেলায় মজনু শাহর অগুনতি ফকিরের সঙ্গে মহাস্থানগড়ের দিকে যাওয়ার সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেপাই সর্দার টেলারের গুলিতে মারা পড়ে মুনশি বয়তুল্লাহ শাহ। কাৎলাহার বিলের দুই ধারের গিরিরডাঙা ও নিজগিরির ডাঙার মানুষ সবাই জানে, বিলের উত্তরে পাকুড়গাছে আসন নিয়ে রাতভর বিল শাসন করে মুনশি।

গীতবিতান

ইন্দ্রার কাছে শুনেছি ওর মায়ের শরীরটা নাকি ভালো নেই। তাই সে এবার বাংলাদেশে আসতে পারেনি। ইন্দ্রাকে একাই আসতে হলো ভিসা সংক্রান্ত কিছু কাজে। পুলকের কথা আমি মুখ ফুটে কিছুতেই জিজ্ঞেস করতে পারছি না। সেদিন ফেসবুকে পুরনো ছবি শেয়ার করার পর ইনবক্সে ইন্দ্রার মেসেজটা এলো। মাত্র কদিন আগে আমাকে ফেসবুকে খুঁজেপেয়েছিল ইন্দ্রা। আমার টাইমলাইনে শিপ্রা আর পুলকের সাথে ছবিটা দেখে ও খুব অবাক হয়ে বলল— আপনি তাহলে আমার বাবামায়ের বন্ধু ছিলেন!

ধূসরিমা ও অন্যান্য কবিতা

এই বসন্তে তোমার স্মৃতি
ডেফোডিলের ঝাড়ে হাওয়ায় উড়ে আসা
এক সাদা-কালো ছবি।

ছিল তোমার প্রেম
মাঠের সৌন্দর্যে গাছের অবদানের মতো—
দূর দেশে বসে সে-কথাই ভাবি।

জেগেছে যে মায়াবী মর্মর

মর্মের মন্দির থেকে তুলে আনা
রক্তাভ যতো ধ্বনি—তুমি,
তাকে নৈঃশব্দে পৌঁছাও
তবু, ঠেকাতে পারো অই চির অমেয় রুধির প্রবাহ?
ঝড়ের অলিন্দ থেকে; যে কোনো গভীর আড়াল থেকে
জেগেছে যে মায়াবী মর্মর—
যেন যতো ভারি পাথরের ছিল, সেসব—

দেবদাসের জীবনপ্রভাত

দেবদাসের দেখার দৃষ্টি সরল। সহজতাই তাঁর লেখার প্রাণ। তাঁর গদ্যের অন্যতম শক্তি হলো পাঠককে সম্মোহন করা। গ্রামের সহজ সরল মানুষ, মাঠ-ঘাট পেরিয়ে এক হাঁটু ধুলোরাঙা পায়ে হেঁটে চলেছেন মাজা বেঁকে যাওয়া এক বদ্যিবুড়ি। তার কাঁধের ঝুলিতে সালসার শিশি, কন্টিকারীর বড়ির কৌটা, আরো কত কিছু! আর সেই বুড়ির সঙ্গে হেঁটে চলেছেন আপনি। হ্যাঁ, আপনি। গাবগাছ, কামরাঙাগাছ, সবুজ ক্ষেতের পাশ দিয়ে গাঁয়ের শান্ত, নীরব পথে। হেঁটে চলেছেন দেশভাগের করুণ ইতিহাসের বোঝা মাথায় নিয়ে।

ধুলোলীন মুখ ও অন্যান্য কবিতা

বিপন্নতাটুকু নাও; এই নাও ধুলোলীন মুখ।
হে জবাকুসুম, হে জলকোমল, হে পীর-পার্বতী—
নাগরিক অন্ধকারে নিরুপায় বসে আছি একা
মিথুন-রেখার পাশে আমাকেও টেনে নিও তুমি—

লাল তালবাগান

সিলভীর সাথে আমার প্রেমটাও ছিল এমন। সত্য সত্য চলতে চলতে তার মধ্যে মিথ্যে ঢুকে গিয়েছিল। দিনে দিনে সেই মিথ্যে আচরণগুলো, সেই মিথ্যে অভিনয়গুলোই আমার জীবনে সত্য হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। একটা বনসাই হয়ে উঠেছিলাম দিনে দিনে। এই যে আমি হীনম্মন্যতায় ভোগা ভীতু প্রকৃতির একজন মানুষ, অথরিটি পার্সোনে আমার জড়তা, সবসময় ‘আমি ঠিক নাই’ ভাবা, বা, এই যে আমাকে কেউ প্রত্যাখান করলে সঙ্গে সঙ্গে সে আমার সমস্ত মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে ওঠে আর আমি তার মনোযোগ আকর্ষণের ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে অবচেতনেই অসংলগ্ন আচরণ করতে থাকি— এসবই তৈরি হয়েছে আসলে সিলভীর সাথে প্রেমের সময়কালে।

মদন তাঁতির মুদ্রাদোষ

সাহিত্য ও রাজনীতির দাম্পত্য সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই। তবে এই সরল বাক্য আদতে সরল নয়— কেননা, মানুষের চিন্তার স্থাপত্যে সাহিত্য ও রাজনীতির সংজ্ঞায়ন যুগে যুগেই ভিন্ন। ‘সাহিত্যে রাজনীতি’, ‘রাজনীতির সাহিত্য’ বা ‘রাজনৈতিক সাহিত্য’ বললে আলোচনার বিষয় ও বাস্তবতাকে খানিক ছোটো করে আনা যায় বটে; কিন্তু তাতে আলোচনাটি ঠিকঠাক মতো হয় না বলেই আমি মনে করি। কারণ, সভ্যতার আদি পর্বে মানুষ মূলত তার চিন্তার সূত্রে শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতি ইত্যাদির অবয়ব দান করেছে। সুতরাং মানুষের চিন্তার বিবর্তনকে যদি প্রেক্ষণে রাখা যায় তবে এটা স্পষ্ট হয় যে, মানুষ মূলত তার চিন্তার চিৎকারে পক্ষ অবলম্বন করেছে বা পক্ষ পাল্টেছে। এই বিবর্তনের ধারা আবার সভ্যতার বৈশিষ্ট্যানুযায়ী ভিন্ন। প্রাচীন গ্রীক, রোমান বা ভারতে মানুষের চিন্তার যে অবমুক্তি ঘটেছে তার সঙ্গে দর্শনের সম্যক সম্পর্ক বিরাজমান।

Begin typing your search term above and press enter to search. Press ESC to cancel.

Back To Top
error: Content is protected !!