কবিতা-অরণ্য হলো সেই রহস্যমেদুর রেইন ফরেস্ট, যেখান থেকে অক্সিজেন নেয় বহু-বহু বিষণ্ন ফুসফুস আর ত্যাগ করে খেদ ও নির্বেদ, গ্লানি ও কার্বন ডাই-অক্সাইড, এমনকি কখনো-কখনো মনোক্সাইডও। আর সেই বৃষ্টিবন ওইসব বিষ ও বিষাদকে ফের রূপান্তরিত করে ফেলে দ্রুত অম্লজানে। কবিতার রয়েছে সেই অভিনব সালোক-সংশ্লেষণী ক্ষমতা।
নীলাক্ষি তীরের আখ্যান ‘উজানবাঁশি’
মিথ বা লোকপুরাণকে আমি কথাসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান বলে মনে করি। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে এত এত মিথ ছড়িয়ে আছে যে, কখনো কখনো মনে হয় গোটা দেশটাই একটা মিথের কূপ। মিথের সঙ্গে এখানকার মানুষের বসবাস। তারা মিথ সৃষ্টি করে, মিথ যাপন করেন, মিথে আনন্দ লাভ করে, মিথে শাসিতও হয়। বাংলায় যত মিথ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, প্রত্যেকটি দিয়ে একেকটি উপন্যাস রচনা সম্ভব, গল্প রচনা সম্ভব। আমাদের ঔপন্যাসিকরা যে তাঁদের উপন্যাসে মিথের ব্যবহার করেননি, তা নয়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’য় দেখি মিথের সফল ব্যবহার। কাৎলাহার বিলের ধারে ঘন জঙ্গল সাফ করে বাঘের ঘাড়ে জোয়াল চাপিয়ে আবাদ শুরু করার দিনের এক বিকেলবেলায় মজনু শাহর অগুনতি ফকিরের সঙ্গে মহাস্থানগড়ের দিকে যাওয়ার সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেপাই সর্দার টেলারের গুলিতে মারা পড়ে মুনশি বয়তুল্লাহ শাহ। কাৎলাহার বিলের দুই ধারের গিরিরডাঙা ও নিজগিরির ডাঙার মানুষ সবাই জানে, বিলের উত্তরে পাকুড়গাছে আসন নিয়ে রাতভর বিল শাসন করে মুনশি।
ন্যারেটিভ : রীতি ও নির্মিতি
শিল্পের মূলে আছে ন্যারেটিভ। কবিতা-নাটক-গল্প-উপন্যাস-মহাকাব্য থেকে চিত্রকলা-সিনেমা সবকিছুর মধ্যে ন্যারেটিভ থাকে। এই কারণে ন্যারেটিভ যদি গল্প হয় তাহলে আমরা বলতে পারি শিল্প-সাহিত্যের সবচেয়ে আদি বিষয় হলো গল্প। গল্প দিয়েই সাহিত্যের শুরু। শুধু সাহিত্য না সবধরনের শিল্পফর্মের মূলে আছে গল্প। চিনুয়া আচেবে বলছেন, মানুষ হতে হলে অবশ্যই তার একটা গল্প থাকতে হবে। মানুষের সেই গল্পটা সভ্যতার […]
হাতিজোতদার, দেশকাল এবং মাতব্বরনামা
দোলং নদীর পাড়ে নন্দকুমার দেউনিয়ার বাড়িতে কুশান পালার আসর ছেড়ে আসবার কালে মাঘমাসের শীতের জাড়ে ঈষৎ বিচলিত হলেও একসময় দোলগোবিন্দ ধনি নিজেকে সামলে নিয়ে কুশায়ায় স্থিরচিত্রের মতো দাঁড়িয়ে থাকা তার দুধবর্ণ ঘোড়াটির পিঠে চেপে বসেন। তখনো তার সমস্ত শরীরে মিশে আছে কুশানের সুর, খোসা নাচের স্পন্দনগুলি। শীতকুয়াশায় ছুটে চলে দোল ধনির নির্জন অশ্বটি আটপুকুরির ধনিবাড়ির দিকেই। এই দৃশ্যে হয়তো একটা দার্শনিকতা থাকে। থেকেই যায়।
মদন তাঁতির মুদ্রাদোষ
সাহিত্য ও রাজনীতির দাম্পত্য সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই। তবে এই সরল বাক্য আদতে সরল নয়— কেননা, মানুষের চিন্তার স্থাপত্যে সাহিত্য ও রাজনীতির সংজ্ঞায়ন যুগে যুগেই ভিন্ন। ‘সাহিত্যে রাজনীতি’, ‘রাজনীতির সাহিত্য’ বা ‘রাজনৈতিক সাহিত্য’ বললে আলোচনার বিষয় ও বাস্তবতাকে খানিক ছোটো করে আনা যায় বটে; কিন্তু তাতে আলোচনাটি ঠিকঠাক মতো হয় না বলেই আমি মনে করি। কারণ, সভ্যতার আদি পর্বে মানুষ মূলত তার চিন্তার সূত্রে শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতি ইত্যাদির অবয়ব দান করেছে। সুতরাং মানুষের চিন্তার বিবর্তনকে যদি প্রেক্ষণে রাখা যায় তবে এটা স্পষ্ট হয় যে, মানুষ মূলত তার চিন্তার চিৎকারে পক্ষ অবলম্বন করেছে বা পক্ষ পাল্টেছে। এই বিবর্তনের ধারা আবার সভ্যতার বৈশিষ্ট্যানুযায়ী ভিন্ন। প্রাচীন গ্রীক, রোমান বা ভারতে মানুষের চিন্তার যে অবমুক্তি ঘটেছে তার সঙ্গে দর্শনের সম্যক সম্পর্ক বিরাজমান।