কবর

তখনও সন্ধ্যা ঘনায়নি। বাগদী পাড়ার পুষ্করের বউ গিয়েছিল চরের খালে মাছ ধরতে। বর্ষাকাল। নদীর এখন ভরা যৌবন। সেই যৌবনেরই ছটা ছড়িয়ে পড়ছে নদীর আশেপাশের খালে-বিলে। মোষমরার চরটা ঠিক আজকালকার চর নয়। শোনা যায়, কোন যুগ আগে নাকি বান এসেছিল নদীতে। মাঠঘাট ডুবিয়ে যখন শান্ত হলো নদী, তখন পলি-বালি ফেলে ফেলে নদীটা অনেকদূর সরে পড়েছে। লাগারডাঙার ঘোষদের একটা হালের মোষ চরতে চরতে শক্ত ডাঙা ভেবে বালিতে পা দিয়ে জল খেতে নেমেছিল। আর উঠতে পারেনি মোষটা। ভড়ভড় করে ঢুকে গিয়েছিল নরম দক-মাটিতে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর যখন রাখালের চোখে পড়েছিল, তখন শুধু একটা কালো মাথা দেখতে পেয়েছিল সে।চোখ বুজে ওপর দিকে মুখ তুলে যেন গভীর ধ্যানে মগ্ন। কেউ যেন গলাটি কেটে কাদার ওপর নামিয়ে দিয়ে গেছে।মোষটার মাথার ওপর দু-তিনদিন শকুন উড়েছিল। ভাগাড় খেকো কুকুরগুলো দহে নামতে সাহস পায়নি। দূর থেকে বসে বসেই জীভের জল ঝড়িয়েছিল— এ হলো মোষমরার চরের বৃত্তান্ত।

কালা চশমা

আমি একবার কাজ করছিলাম একটা সফটওয়ার কোম্পানিতে। সেইখানের কাহিনি। আগে কখনো বলা হয় নাই। আজ মনে হইতেছে এই কাহিনিটা বলে ফেলি।

কোম্পানিটার নাম না বলি। সফল একটা ব্যবসা হিসাবে তাদের নামডাক আছে। ভালো কাজ করতেছে, ঢাকায় ছিল অফিস। আমি তখন ঢাকায় গেছি, অফিসের কাছেই বাসা নিয়া থাকি।

অফিস শুরু হয় নয়টায়। সকাল সকাল সবাই আইসা গোল হইয়া দাঁড়াইয়া মিটিং করেন, এটা তাদের নিয়ম। আমি এগারোটায় উইঠা অফিসে যাইতাম। গিয়া প্রথমে এইচআরের রুমে বইসা কিছু ফাও আলাপ করতাম। চা খাইতাম, এবং ঘন্টাখানেক পরে নিজের জায়গায় যাওয়া শুরু করতাম।

লাল তালবাগান

সিলভীর সাথে আমার প্রেমটাও ছিল এমন। সত্য সত্য চলতে চলতে তার মধ্যে মিথ্যে ঢুকে গিয়েছিল। দিনে দিনে সেই মিথ্যে আচরণগুলো, সেই মিথ্যে অভিনয়গুলোই আমার জীবনে সত্য হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। একটা বনসাই হয়ে উঠেছিলাম দিনে দিনে। এই যে আমি হীনম্মন্যতায় ভোগা ভীতু প্রকৃতির একজন মানুষ, অথরিটি পার্সোনে আমার জড়তা, সবসময় ‘আমি ঠিক নাই’ ভাবা, বা, এই যে আমাকে কেউ প্রত্যাখান করলে সঙ্গে সঙ্গে সে আমার সমস্ত মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে ওঠে আর আমি তার মনোযোগ আকর্ষণের ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে অবচেতনেই অসংলগ্ন আচরণ করতে থাকি— এসবই তৈরি হয়েছে আসলে সিলভীর সাথে প্রেমের সময়কালে।

নাস্তিক বিজ্ঞানী

একজন সাংবাদিক লুইসকে থামিয়ে বললেন, স্যার বিজ্ঞানের কণা নিয়ে আপনার আজকের আলোচ্য বিষয়। আমরা অধির আগ্রহে শোনার জন্যে অপেক্ষা করছি। এখানে কয়েকজন রাজনীতিবিদ, জনগণের নির্বাচিত এমপি এমনকি মন্ত্রীও রয়েছেন। দেশ সেরা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও শিক্ষানুরাগী আছেন। বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্টরা উপস্থিত আছেন আপনার মূল্যবান বক্তব্য শোনার জন্যে। নামকরা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের সেরা শিক্ষক ও ছাত্ররা এসেছে অভিজ্ঞতা নিতে। এখন সময় বারোটার অধিক। আপনি মূল বক্তব্য নিয়ে আলোচনা করলে ভালো হয়।

গীতবিতান

ইন্দ্রার কাছে শুনেছি ওর মায়ের শরীরটা নাকি ভালো নেই। তাই সে এবার বাংলাদেশে আসতে পারেনি। ইন্দ্রাকে একাই আসতে হলো ভিসা সংক্রান্ত কিছু কাজে। পুলকের কথা আমি মুখ ফুটে কিছুতেই জিজ্ঞেস করতে পারছি না। সেদিন ফেসবুকে পুরনো ছবি শেয়ার করার পর ইনবক্সে ইন্দ্রার মেসেজটা এলো। মাত্র কদিন আগে আমাকে ফেসবুকে খুঁজেপেয়েছিল ইন্দ্রা। আমার টাইমলাইনে শিপ্রা আর পুলকের সাথে ছবিটা দেখে ও খুব অবাক হয়ে বলল— আপনি তাহলে আমার বাবামায়ের বন্ধু ছিলেন!

একটা খুশির দিন

মতিন শেখের কী জানি হয়। মিষ্টির প্যাকেট হঠাৎই খুলে ফেলে। একটা একটা করে মিষ্টি উঠানের সবাইকে দিতে থাকে মানত মানা সিন্নির মতো করে। বড় চমচম… নেবো কি নেবো না করেও সবাই নেয়। কেউ কেউ বলে, মরার বাড়িতে মিষ্টি আবার খাই ক্যামনে?
কিন্তু সবাই খায়। নান্টু ঘোষের সুনাম করে সবাই। জামাই বলে, আবার কি ছিট তুলছেন নাকি মাথায়? এহন মিষ্টি খাওনের সময়?
মতিন শেখ বলে, মাইয়া মরার খুশিতে খাওয়াই বাবাজি। তুমিও খাও। এমন খুশির দিন আমার মাইয়াটার জীবনে আর আসে নাই!

বোধ

সে ছিল এক বাপের একমাত্র ছেলে। শহরে পৌরসভার ভিতরে এক বিঘা জায়গা জুড়ে তাদের বসত ভিটা। দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। মা-ও নাই। এক বিঘে জমির ওপরে তাদের মূল বাড়ি বাদ দিয়ে সেমি পাকা টিনের ঘর আছে চারটা। বাবা ওগুলো ভাড়া দিত। সেই ভাড়ার টাকাতেই তাদের সংসার চলত। জামালির মাথায় লেখা-পড়া কিছু ঢুকল না। ম্যাট্রিক পাশটাও করতে পারল না। বয়স একুশ হতে না হতেই বাপ বিয়ে দিয়ে দিল লম্বা চওড়া দশাসই চেহারার জামালের। আর এই বিয়েটাই কাল হলো।

বাবা

যে শৈশব ভুলে যেতে চায় তরী, সেই শৈশবে সে বাবাকে ভালোবাসত। বাবার সাইকেলের সামনের রডে বসেই টো টো ঘুরে বেড়ানো। বাবার কাছেই ঝোড়া-ভরা আবদার। মায়ের খাঁ খাঁ শাসনের একপাশে বাবার একফালি প্রশ্রয়ের মরুদ্যান। রোববার টিভিতে অ্যালিস যখন জাদু-গর্তে ঝাঁপ দেবে দেবে, সেই সময় বাবা গলা-খাঁকারি দিয়ে বলত, ‘ঠিক আছে, আর অঙ্ক করতে হবে না। আজকের মতো ছুটি।’ রান্নাঘর থেকে মা ছুটে আসত। উত্তেজনায় হাতের খুন্তি নড়ত এদিক ওদিক। ‘একদম না, প্র্যাক্টিস করুক। সবসময় ওর তীরে এসে তরী ডোবে।’

সামুদ্রিক

জলে নামতে জানত দেবলীনা। চটিজোড়া খুলে রেখে পোশাকের তোয়াক্কা না করে তড়তড়িয়ে এগিয়ে যেত ঢেউ ভেঙে। সোমক তাকে দেখত অবাক হয়ে। সমুদ্রের বুকের ভেতর মিশে যেতে যেতে দেবলীনা ক্রমশ সমুদ্র হয়ে যেত। কখনো সোমকের হাত ধরে টেনে নামালেও সোমকের শরীরটুকু ভিজত কেবল, দেবলীনার মতো করে জলদেহে ঢেউ হতে পারত না সে। জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে জল দেখত, দেবলীনাকে দেখত। সাগর অধরা থেকে গেল, মেয়েটাও। সে মেয়ে লবণ লবণ… শিখেছে সহজ মিশে যাওয়া… জলসমুদ্রে, জনসমুদ্রে।

নিশা

নিশা চলে যাওয়ার পর আমার তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না। খাওয়া-দাওয়া আগের মত চলছে, ঘুম আগের চেয়েও দীর্ঘ হয়েছে। বাইরে যাওয়া, অফিস, স্বাভাবিক কাজকর্ম আগের মতই চলছে। কোথাও কোনো ছেদ নেই। কেবল, একটা ঘটনা ছাড়া। আমার সব কথা ফুরিয়ে গেছে। আগের মত বলে যেতে পারি না। যতটুকুই বলি, পেঁচিয়ে যায়। আর বলবই বা কার সঙ্গে? প্রতিদিন অফিস ছাড়া নিয়মিত আর কোথাও, কারো কাছে যাওয়া হয় না। তাই কথা বলার প্রয়োজন পড়ে না তেমন।

Begin typing your search term above and press enter to search. Press ESC to cancel.

Back To Top
error: Content is protected !!