হিজল জোবায়ের-এর কবিতা

Posted: জানুয়ারি ২৬, ২০২১
Category: কবিতা
By:


তাহলে বসন্ত এলো
°
তাহলে বসন্ত এলো রক্ত-কুসুমিত,
সন্তের ক্রূরতা আর খুনীর সন্ন্যাসে

দিগন্ত পেরিয়ে—
দল বেঁধে রক্তমুখা ইঁদুরেরা আসে

তাহলে বসন্ত ভালো, হিম-কুসুমিয়া?

শেষবার জ্বলে উঠে শ্বেত ফসফরাস
নিভে গেলো জীবনের আশ্চর্য কিমিয়া!

নিদালি প্রান্তরে কারা হয়েছে মুখর,
সাপ আর শয়তানের উদগ্র সঙ্গম;

ধাবমান বসন্তের-শববাহী-ঘোড়া,
রথের সারথী হাওয়া, অন্ধ নিরঙ্গম

বসন্তেও পাতা ঝরে,
পাতা ঝরে,
পাতা ঝরে,
পাতা ঝরে— এতো শব্দময়!

রিহার্সেল
°
সকাল সকাল মৃত্যুর রিহার্সেল করছে শিশুরা।

এ ওকে গুলি করছে
সে তাকে।
ও পড়ে যাচ্ছে ঘাসের ওপর
এ পড়ছে নদীতে।

একজনের লাশ আবার
গুম করে দিচ্ছে আরেকজন।

বাগানে পুঁতে রাখছে মানুষের চারা।

গাছের গোড়ায় মাটি বেঁধে
মঞ্চ বানানো হয়েছে।

সেখানে দাঁড়িয়ে একজন বলছে—
সব ঠিক আছে। ঘাবড়াবেন না।
শান্ত হন, শান্ত হন।

সন্ধ্যাভাষা
°
শীতকালের কাছাকাছি এ সময়,
পৃথিবীর দিকে ঝুলে আছে অপার্থিব সন্ধ্যার ছায়া।

তোমার স্মৃতির বাইরে দেখো যেতেই পারছি না।

শহরের শেষ মাথায় বুচারি হাউজ,
নমিতমান গাছপালায় ঢাকা।

ছোটো ছোটো পায়ে হাঁটি,
আবার নতুন করে চোখ খুলে দেখি—
এ কেমন নতুন চারপাশ!

বায়ু-সমুদ্রে আকাশমণি ভাসিয়েছে
নৌকার মতো পাতা।

জ্বর ছেড়ে গেলো;
বাতাসে কীসের গোপন অঙ্গীকার।

জলাশয়ের পানিতে দুলছে অচেনা ফুলের ছায়া।

গোধূলির ম্লান আলোয়—
প্যাগোডার বিষণ্ণ মিনার থেকে শিস দিয়ে উড়ে গেলো পাখি।

ছাতিম
°
শীতের প্রাকভাগে সেবার সন্ধ্যায়
রাত্রি ঝুঁকে ছিল আকাশগঙ্গায়,
কুয়াশা নদীতীরে মগ্ন-শিশিরে
ছাতিম ফুটেছিল তোমার জঙ্ঘায়

সে কথা মনে আছে?

অর্ধ-জাগরণ, অর্ধ-তন্দ্রায়
সে ফুল বেড় দিয়ে মারণ-কুণ্ডলে
একটি সাপ ছিল অধীর ফণা তুলে

সে কথা মনে আছে?

ঝোড়ো বাতাস ছিল তোমার নিঃশ্বাস
জলোচ্ছ্বাসে ডোবা মরণ-চিৎকার—
শতাব্দীকালের নিচে চাপা পড়া
ডুকরে ওঠা এক কোমল-গান্ধার

পাতালে ডুবে যাও, পাতালে ডুবে যাও

যতোটা পাতালে— ততোটা বাসুকির
ততোটা উচ্ছ্রিত তীব্র কালকূট,
যতোটা ডুবে যাবে— ততোই নাগপাশ
পেছনে ডেকে চলে আবহকুক্কুট

এতোটা দ্ব্যর্থক এ কোন রাহুগ্রাস
জীবন ভোগ চায় এ কোন রাক্ষস,
একটি পাখা আছে এখনও ঠিকঠাক
কোথায় জটায়ুর আরেক পক্ষ

পক্ষাঘাত থেকে এই তো ফিরেছি,
আবারও হিমযুগ, আবারও সন্ধ্যা,
আবার পথে নেমে ধরেছি সন্ন্যাস
ছাতিম ফুটে আছে তোমার জঙ্ঘায়…

সিঁড়ি
°
অনেক বিড়াল ছাদে
মেঘের ছায়া ফেলা
এই শান্ত বিকালবেলা
ঘুমাচ্ছে একসাথে

বাতাস-বওয়া শিস
পাতাবাহার গাছে—
বলছে— আরও আছে
শোনো গহীনে বন্দিশ

ভাঙতে গেলাম সিঁড়ি
ধাপগুলি বাধ সাধে
আমার আশ্বিনী সন্ধ্যা
ভিজে যাচ্ছে পূর্ণিমাতে

স্বপ্নে মেঘের তস্তুরিতে
ভাসে সোনার মেকুরদল;
আহা ঠাণ্ডা দুধের বাটি
আমার এইটুকু সম্বল

আমি ভাঙতে গেলাম সিঁড়ি
দেখি হাড়ের মধ্যে ঘুণ;
দু'পা পিছলে পড়ে গেছি
—মরার শরীর জুড়ে ঘুম

অনেক বিড়াল ছাদে,
কাঁদে ঘুমের মধ্যে কাঁদে

অগস্ত্যযাত্রা
(অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের করকমলে)
°
কী যেন তার নাম?
সেই যে শ্রাবণে কাকভেজা হয়ে
যাকে পৌঁছে দিয়েছিলাম।
বাড়ির গেটে সেই বাগানবিলাস গাছ,
এখনো আছে? নেই।
আমি বৃথাই ফিরে এলাম।

এ আগুনপরিখা,
এই অনল, দীপশিখা
এ মন, হাওয়া সঞ্চালন
আমি পাইনি তার দেখা।

হাওয়ায় জাহাজডুবি হয়,
হাওয়ায় ধুলট বসন্ত,
হাওয়া শূন্য করোটির
তামস দ্ব্যর্থকতাময়।

এই বিকাল শেষ হবে
ঝরাপাতার ঔড়বে,
মানুষ যা খোঁজে তা পায়?

কেবল ধুলার তামান্না।

বিরান বধ্যভূমি আর
উতল রক্তবীজের ঝাড়
এমন অগস্ত্যযাত্রায়।

নওফিয়া
°
বিস্কুট ফ্যাক্টরির গলিতেই আমরা ছিলাম কিছুদিন হলো। অদূরে
মিলিটারিদের আটার গুদাম, সে আটা রৌদ্রে শুকায়, বৃষ্টিতে ভেজে, আটার
গন্ধ বাতাসে ভাসে, কুর্মিটোলা কলোনির বাতাসে বাতাসে।

ছোটো জংলাপথ, তারপরে বাতিল এয়ারোড্রাম।

আছড়ে পড়া কপ্টারের ভাঙা ডানা, লেজ। লেজের মাথায় কুট্টি জংলি
ফুল, অস্তোন্মুখ সূর্যের মতন, বেদনা-রক্তিম।

তারপরে সবকিছু কুয়াশা-বধির। ভারী ভারী পাতার বাগান; মন্থর
বোবা-বাতাস; জনশূন্য নওফিয়া।

মাতৃগর্ভ
°
মায়ের কবর সারাবেন বলে চলে গেলেন নিঃসঙ্গ লোকটা। আজ দুপুরে
উনি ষাটে পৌঁছলেন।

সরিষা ফুলের মতো রোদ ফুটে আছে। জলাশয়ের পানিতে পড়ে আছে
মঠের ছায়া। ধীরে ধীরে মেঘ করে এলো।

শিশুদের মতো চঞ্চল হয়ে বৃষ্টি নামলো। আকাশ ছেয়ে নিল মাতৃগর্ভের
তমসার মতো মেঘ।

বাতাস বইছে। বাতাসে দুলছে দীর্ণ কলাপাতা।

চিরসঙ্গীতের মতো বৃষ্টি ঝরছে।
নিভে আসা দিবসের শেষ আযান
ভেসে আসছে দূরের মসজিদ থেকে।

মাতৃগর্ভের তমসার মতো অন্ধকারে ভাঙা কবরের সুড়ঙ্গ বেয়ে ঢুকে
পড়ছে বৃষ্টির অবিরল ধারা।

কোথাও তক্ষক ডাকছে। পাখিরা ডানার নিচে লুকিয়ে রাখছে ডিম।

আযান শেষ হলো। পাতালের সিঁড়ি বেয়ে অনন্ত কবরের দিকে নেমে
গেলো নিঃসঙ্গ লোকটা।

একাকী সে পাহাড়চূড়ায়
°
খোদার উদাসীন নীরবতার মতন এই সন্ধ্যা,
যেন এক চিৎকার এর কণ্ঠে রুদ্ধ হয়ে আছে।

ফুটে আছে নমরুদ-পাহাড়ের গায়ে
আত্মার নগ্নতায় ছাওয়া এক ফুল;
পাপড়িতে উন্মিলীত সন্ধ্যার ভার,
গর্ভাশয় বেড় দেওয়া আঁধার-ময়াল।

সমাচ্ছন্ন মাগরিবের কালে-
আমাকেও ডাকে সেই ফুল
একাকিনী পাহাড় চূড়ায়;

আমি কি পাহাড়ে যাবো?
আমার ইসমাইলকে নিয়ে
ইব্রাহিম নবীর মতন?

তারপর দুম্বার কাটা গলা থেকে
অবিরাম খুন ঝরে, খুন ঝরে, খুন।

পাহাড়ও ডাকতে জানে, কোনো একদিন
মুসাকেও ডেকেছিল খোদার আগুন।

~ঝরাপাতার এস্রাজ~
°
বৃত্তের বিশেষত্ব এই, তা কখনো পড়ে যায় না।
°
কল্পনার চেয়ে বড় কোনো মিথ্যা নাই। অথচ কল্পনা সত্য।
°
এক চোখ দেখতে পায়নি আরেক চোখকে। নিজেও নিজেকে দেখেনি চোখ।
°
সবচেয়ে বড় কথা, আয়নাও নিজেকে দেখতে পায়নি কোনোদিন।
°
কাছে গিয়ে বোঝা হলো, নিকট কতোটা দূর।
°
আমাকে খুঁজে পাবে ভাষা ও ভাবের বিয়োগফল থেকে।
°
যার জন্য আকূল অপেক্ষায় আছি, দোহাই, সে যেন আগামীকালই ফিরে না আসে।
°
বাদামের খোল ভেঙে আমরা বেরিয়ে পড়েছি, বাদাম-দম্পতি।
°
স্মৃতিই মৃত্যুর কারণ। স্মৃতিহীন কখনো মরে না।
°
সাফল্যের সঙ্গে ব্যর্থ আমরা।
°
নীরবতা এক পাখি, যে গান গায় ধ্যানীর অন্তরে।


শেয়ার করুন

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts

Begin typing your search term above and press enter to search. Press ESC to cancel.

Back To Top
error: Content is protected !!