লাইফ ইন বরেন্দ্র : জলরঙে সুমনের কাব্যিক উচ্ছ্বাস

Posted: নভেম্বর ২৪, ২০২০
Category: চিত্রকলা
By:

সুমন। সুমন কুমার সরকার। আমার বন্ধু। আমার সহপাঠি। বগুড়া আর্ট কলেজ থেকে এক সাথে। কত স্মৃতি আমাদের! কত খুনসুটি আমাদের! প্রি-ডিগ্রি শেষ করে ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাবার পর বহুদিন ধরে আমাদের বন্ধুত্ব দৃশ্যের বাইরে গিয়ে ভেতরে ভেতরে শেকড় গজিয়েছে। আমার স্বভাবজাত সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে সুমন আমাকে বন্ধু স্বীকার করে। আর আমরা বেড়ে উঠি চিত্রকলার টোন প্র্যাকটিস করতে করতে, লাইন প্র্যাকটিস করতে করতে, রঙ ও রসিকতা করতে করতে। আমি অ-চিত্রের বাহক। সুমন সু-চিত্রের। মূলত জলরঙ নিয়ে কাজ করে সুমন। জলরঙের ভেতর ও নিজের ভেতরের স্বচ্ছতাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। সুমন বলে- ‘জলরঙ করার সময় যেভাবে ধ্যানস্ত হতে হয়, মানসিক ফ্রেসনেস প্রয়োজন হয়, চিত্রের অন্যান্য শাখায় তা ততটা না হলেও চলে। সময়ের এই জটিল আবর্তে প্রতিটি শিল্পীরই আর্ন্তস্বচ্ছ হওয়াটা জরুরী। জলরঙের ভেতর দিয়ে আমি সেই স্বচ্ছতার দিকে অগ্রসর হই।’


গত ১৬ থেকে ২৯ এপ্রিল ২০১৩, আঁলিয়স ফ্রঁসেজ দো ঢাকার গ্যালারিতে `Life in Varendra' বা ‘বরেন্দ্র জীবন’ শিরোনামে একটি প্রদর্শনী হয়ে গেল। ৩৫টি চিত্রকর্ম নিয়ে শুরু হওয়া এই প্রদর্শনীতে প্রায় প্রতিদিনই যাওয়া হয়েছে। শুধু যে বন্ধুত্বের টানে গেছি, তা নয়। গেছি চিত্রসৌন্দর্যের মুগ্ধতাহেতু। অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি জলরঙের ভেতর দিয়ে জ্যান্ত হয়ে ওঠা বরেন্দ্র অঞ্চলের জীবন। প্রাণী ও প্রতিবেশ। লক্ষ্য করেছি রঙের বিন্যাস। সুমনের চোখে দেখেছি, ঋতু বৈচিত্রের বাংলাদেশে বরেন্দ্র অঞ্চলও কেমন নানা মাত্রার রূপে ও রূপকে রঙিন হয়ে ওঠে! হালকা ওয়াশের মধ্য দিয়ে কত কত রঙ যে ছড়িয়ে দিতে জানে সুমন, তাই ভাবি! ভিউ-পয়েন্টে সামান্য স্ট্রোকের ব্যবহার কিভাবে চিত্রটিকে জীবন্ত করে তোলে, শিল্প করে তোলে এই ভাবি। আর দেখি ওর সারল্য। এখনো কেমন শিশুতোষ একটা হৃদয় লালন করছে সুমন, আহা! এই জটিল আবর্তে পাক খেতে খেতে কীভাবে সুমনকে ছেড়ে আমরা হঠাৎ বড় আর বিকৃত হয়ে গেছি তাই ভাবি। ওর সারল্য ধরা পড়ে ওর ছবির মানুষগুলোর মুখ-চোখের দিকে তাকালেও। কী নিস্পাপ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে ওর ‘সাঁওতাল শিশু’গুলো।


সুমনের ছবিতে চিরায়ত গ্রাম-বাংলার চিরপরিচিত রূপটাই খুঁজে পাওয়া যায়। বাঁশঝাড়, গরুসহ গরুর গোয়াল, নদী-ঘাট, খেজুর গাছ, ঘরের ছাউনি দেয়া ও টালিঘর, গরুর গাড়ি, গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠো পথ, মানুষের মুখরতা আর আছে মাটির ঘর। মাটির-ঘর আর লাল-মাটির এই চিত্রসৌন্দর্যই আলাদা করে বরেন্দ্র অঞ্চলের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এ অঞ্চলের পল্লীর দৃশ্য, বয়ে চলা নদী, নদীর দুপাশে গ্রাম, সাঁওতাল জনপদ এ সবই ওর ছবি আঁকার বিষয়। সুমন নাগরিক জীবনে অভ্যস্থ হলেও ওর চিত্রের বিষয় কৃষিভিত্তিক গ্রামীন সমাজ। ও মনে করে- আধুনিক নাগরিক জীবনের শক্তির যোগান আসে গ্রামের কৃষকের ঘামে ভেজা ফসল থেকে। তারা ব্যর্থ হলে মুখ থুবড়ে পড়বে সভ্যতার চলনশক্তি। সম্ভবত এ প্রদর্শনীর ভেতর দিয়ে সুমন নাগরিক মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছে নিজেদের শক্তির উৎসের খোঁজ। দিতে চাইছে একটু স্বস্তির সুবাতাসও।


ইনস্টলেশন, মিক্সড মিডিয়া ও অ্যাবস্ট্রাক্ট ছবির ধাক্কায় চিত্রকলা যখন তার আদি শৈলীটি প্রায় ভুলে যেতে বসেছে, রিয়েলিস্টিক ধাঁচে আঁকা ওর জলরঙের এই ছবিগুলো যেন ভুলে যাওয়া সেই গালে একটা কঠোর কঠিন চপেটাঘাত। রিয়েলিস্টিক ছবির ভেতরও যে নানা মাত্রার এক্সপেরিমেন্ট করা সম্ভব সুমন সেটা করে দেখিয়েছে। ভায়োলেট কালারের প্রতি ওর গোপন একটা মমতা লক্ষ্য করা যায়। এই মমত্ব ওর চিত্রসৌন্দর্যকে ক্ষুন্ন করে না বরং এই মমত্বই ওর নিজস্বতার বাহক।


সুমন, অভিন্ন এক পথের বাঁকে আমাদের আবার দেখা হবে। সে দেখায় আমার হাতে হয়তো থাকবে নলখাগড়ার বাঁশি, তোমার হাতে যেন থাকে শৈশব থেকে বয়ে আনা একটা কলাবতী ফুল।


শিল্পযাত্রা অব্যাহত থাকুক, বন্ধু।





খেয়া ঘাট




মনিং লাইট




লাইফ ইন বরেন্দ্র




সাঁওতাল ভিলেজ-৩

বিধান সাহা

কবি ও গদ্যকার



শেয়ার করুন

Begin typing your search term above and press enter to search. Press ESC to cancel.

Back To Top
error: Content is protected !!