দাগ ও অন্যান্য কবিতা

Posted: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২১
Category: কবিতা
By:


দাগ

উনুনের রক্তরঙে লাল হয়ে ঘেমে ওঠে মুখ
চিড়-ধরা দেওয়ালে সঞ্চিত থাকে হিমঘ্ন অতীত
নিদ্রিত শিশুর মতো আধোলীন স্নেহের দাপটও
ক্ষয়ে যায়, জন্ম তার ছেঁড়ে— থাকে দাগ, চিদাকাশে

প্রাণের সমস্ত কড়া নেড়ে নেড়ে খসে পড়ে যায়
কে রয়েছে? আছে কেউ, পথ রুখে দাঁড়ায় সম্মুখে?
হয়তো দাঁড়ায় কেউ, ধুলোপাশে ছেঁড়া ছাতা ধরে
সহজ জলের ঢঙে অভ্যাসে গড়ায় অবনত

ভেসে যায় উত্তরীয়, নিমীলিত পতাকার হাওয়া
উঠোন জমিয়ে রাখে রহস্যের ছেড়ে যাওয়াটুকু…

আহ্লাদের চাঁদ

বিদায়ের গাঢ় রঙে ফুটে ওঠা বিরহের ফুল
বিবাহের মালা হয়ে দেখিয়েছে নিজের মহিমা
দূরের পাহাড় থেকে ভেসে আসে ভ্রম-সমাবেশ
আধখানা ডাল ভেঙে জ্বালিয়েছে স্বতন্ত্র আগুন

নববিবাহের শীত হু হু করে ঢুকেছে পাঁজরে
ম্লান লণ্ঠনের নিচে গলে যায় আহ্লাদের চাঁদ
পুরুষের অভিশাপ স্তনযুগ পার হয়ে এসে
ভেজা চুলে ঢেকে দেয় আধক্ষয়া সাবানের জ্বর

হেমন্তঘুড়ি

প্রতি জিজ্ঞাসা প্রশ্নপ্রতিমা হয়ে
ঝুলে থাকে কারো হাড়গোড়ে, অভিমানে

ছড়ানো বোতামে লেগে থাকা প্রিয় হাত
খুব করে ছোঁয় শেষ হেমন্তঘুড়ি

না-থেকেও থাকা পাতাঝরা মেঠোপথ
বনের অধিক নিবিড়তা চোখেমুখে

শঙ্খকুয়াশা ডানাভাঙা এক ঘুঘু
রোদের গল্পে ডিঙিয়েছে খা খা বাড়ি

কে তাকে শেখাল দুর্দিনে ভেসে থাকা
আশাবরি ঠাটে এ-মুখর নীরবতা

একাগ্রতা

নিজেকে দেখেছি— উল্টেপাল্টে কবিতা লেখার ছলে
মৃত সভ্যতার কত ছাইভস্ম আমার ভিতরে
কত হাঁচি-কাশি, শ্লেষ্মা, বিবিধ রক্তবীর্যের ফেনা
পাহারায় বসে আছি, শূন্যে উড়ি মাছির আদলে

অন্যের ধাতুতে গড়া জুতো পায়ে হেঁটে গেছি কত!
বৈমাত্রেয় এ-শহরের রাস্তায়, কবিতার লোভে
সুদীর্ঘ নিদ্রার পর জেগে দেখি আমারই পা নাই
অকীর্তির বোধ আজও ক্ষয় হয় ক্রোধে অবিরত

কেন এত উত্তেজনা, কেন এত শান্তি ভেঙে দিয়ে
নিজেকে নিঃশেষ করে কবিতাসভায় ঘুরিফিরি
ভালো— নৌকা নিয়ে কথা বলি, অথবা ধানের শীষ
কার সাথে কার পরকীয়া, কার-বা পালিয়ে বিয়ে

নিজের খোলস খুলে যতটা নগ্ন মানুষ হই
কবিতা শূন্যতাশিশু, আমি শূন্যে উড়ে-যাওয়া খই

দুঃসময়

যেদিন তুমি ইশারা করেছ, আমি গলে গেছি
খলবলে নদী, ভেতরে ভেতরে বাড়ল আমার জল। পাল উড়ল হাওয়ায়। দুলে উঠল লবঙ্গের বন

কত বন-উপবন ঘুরে, আমরা গৃহস্থ জানালার কাছে বসি! স্বপ্নে হাঁটিচলি-স্বপ্নে বসবাস

পৃথিবীজুড়ে খরা এলো। জল শুকিয়ে কাঠ। প্রান্তরের আগুনপ্রসবা পাতায় কবে কার বুকের আগুন জ্বলে উঠল!

তুমি পুড়ে গেলে আদ্যোপান্ত। ভস্ম হলো আমাদের মায়াসভ্যতা
অচল হলো সুদিনের ঘড়ি—

তুমি আজ স্থির, অনড় পাথর
আর আমি পাথর ঠেলছি। যেন আমি সে-ই অভিশপ্ত সিসিফাস

যেন, একবার কাউকে ইশারা করেছিলাম
দেখেছি তার চোখ নেই, নাক নেই
অন্ধ, ঘ্রাণহীনের প্রতি হাঁটুমুড়ে বসে থাকা তবে কি চিরকাল!

ভ্রম–সমাবেশ

তুমি দূর হাওয়া, অনতিদূর গন্তব্যে ফুটে আছ
গত শতাব্দীর জ্বর, অসম ঋতুরক্তের লাল
লেগে আছ ভ্রম-সমাবেশে। যেন এক অন্ধ ঘোড়া
খুরে করে নিয়ে গেছে সবুজ বয়স সবিস্ময়ে।

তুমি প্রণয়কলহ ছুঁয়ে বসে আছ— থির জল
অভিমানে অবিন্যস্ত বও। কাকে ভেঙে কাকে
গড়ো বর্ণময় করে? মগ্ন হয়ে কাকে ঘষে মোছো?
অনঙ্গের ঝরাপাতা উড়ে গেছে প্রজাপতি হয়ে!

ম্লান লণ্ঠনের নিচে ধুয়ে নেবে অঙ্গদগ্ধ দাগ?
আকুতি ধ্বনিত হয় আদিগন্ত—অন্তরীক্ষজুড়ে
বিক্ষত প্রশ্নের নীচে মূঢ়তাও পরিহাসময়
রাত্রিলেখাজুড়ে আছে বিরুদ্ধ হাওয়ার প্রতিধ্বনি

বহুদূর খুঁড়ে তুলি, খুঁজে পাই তোমার প্রচ্ছায়া
অস্ফুট বাক্যের পর অনেকটা নীরবতাসম

স্বভাবরেখা

অনেকদিন দেখা না-হলে— অনাথ শরীরের ভেতর বিঁধে থাকে হু হু। শস্যহীন মাঠে হাওয়ার ঋতুস্নান কুয়াশা-পালকে ভেসে যায়। চোখেমুখে বয়স আঁকে তার অকুণ্ঠিত স্বভাবরেখা।

অনেক অনেকদিন দেখা না-থাকায় তুমি এমন গুঁজে থাকো কম্পিত পাঁজরে! ভয়, প্রেম অথবা আহ্লাদে…!
যুগল পাও বিচ্ছেদরেখা পেরোতে পারে না।

দুপুরস্মৃতি

এঁটো হাত ধুয়ে নিতে নিতে তোমাকে মা বলে ডাকছি। চাল আর ধান থেকে পাথরের বিচ্ছেদ কুড়োতে কুড়োতে তোমাকে ডাকছি যমজ বোন। পালকের ব্যথা ভাগাভাগি করি। আমার সর্বস্ব দিয়ে রচনা করছি আনন্দ নিকেতন। আর ধুলোর অভ্যর্থনা পেরিয়ে গজদন্ত খুলে হাসে পথের পাঠশালা। বুকে চাপা বই, গনগনে প্রণয় আকাঙ্ক্ষা। নীরবে কত শব্দজাল বুনে রাখা হয়! পাঠের আসরে যারা আসে তাদের কেউই শেখেনি বর্ণমালা। কেবল একজোড়া তিতিরের চোখ মুখস্থ করতে করতে আমাদের দুপুরগুলো রাঙা হয়ে ওঠে।

ধর্মজিজ্ঞাসা

সকল ছেড়ে যাওয়ার পাশে শুয়ে থাকে মেঘের করুণ হাসি। অবিরাম বৃষ্টি অনুভব। সকাল শুরুর মতো দূর মাঠে হেসে ওঠা ধান যদি ফিরে আসে ঘরে! তবে কি জীবন আরও নবান্নের দিকে হাঁটুমুড়ে বসে?

স্বাক্ষর

বনে বনে অনেক ফুল তো ফোটে। আমার কেবল বারান্দাতেই চলে। একটা দুটো ফুল কিংবা পাতা, তাদের সাথে দিব্যি ভালো আছি। ঘন সবুজ জানালা থেকে পাখি, গহন একটা দুপুর ছুড়ে দেয়। এতেই জাগে বিকেলবেলার নদী, এতেই আমার সরোদ ভালো বাজে। এতেই কুহক-বিভোর কেটে যায়, মরুপথে আগুনরাঙা আঁচে। বিষণ্ণ এক শস্যপোকা বিনাশপূর্বে অন্ধ হয়ে নাচে। আমি না-হয় পাখনা-কাটা মাছ। সারাটা দিন সাঁতার দেখে দেখে, ডানার নিচে লিখছি শরবন। রৌদ্র ধু ধু বালির ওপর কাটিয়ে দিই নিজস্ব জীবন। কোথাও যদি বন থাকলো, আমার না-হয় থাকুক একটু হাওয়া! শালিখজন্ম আমার হলো। জলার পাশে বন্ধুহীন এক ঘর। এই পৃথিবীর ঈর্ষারেখায় থাকলো একটু অন্যেরও স্বাক্ষর!


রিমঝিম আহমেদ

কবি ও ঔপন্যাসিক
জন্ম: ৮ জুলাই ১৯৮৫, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।
পেশা: উন্নয়নকর্মী
প্রকাশিত গ্রন্থ:
কবিতা: লিলিথের ডানা  [চৈতন্য, ২০১৬] কয়েক লাইন হেঁটে  [জেব্রাক্রসিং, ২০১৮] ময়ূরফুলের সন্ধ্যা  [বাতিঘর, ২০১৯] সুবেহ তারা  [তবুও প্রয়াস, ২০১৯]
উপন্যাস: বিস্ময়চিহ্নের মতো [বাতিঘর, ২০২০]
ইমেইল: rimjhimahmed85@gmail.com

শেয়ার করুন

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts

Begin typing your search term above and press enter to search. Press ESC to cancel.

Back To Top
error: Content is protected !!