
বিধান সাহা কবির নাম মুছে কবিতাগুলি পড়তে দিলেন, যাতে আলোচনার ক্ষেত্রে কগনিটিভ বায়াস প্রভাব না ফেলে। কিন্তু, কবির উম্মেষকাল ও রচনার কাল বিস্মৃত হয়ে কবিতার যথার্থ মূল্যায়ন আদৌ সম্ভব? আমার ধারণা ছিল, নাম মুছে দিলেও আমি হয়তো বুঝতে পারবো কবিতাগুলি কার লেখা। কিন্তু সেটা হলো না, তবে অনুমান করতে পারি, একুশ শতকের কোনো কবিরই রচনা পড়লাম, দুই-তিনটি নামও মাথায় ঘুরছে। একুশ শতকের কবিরা আমার সমসাময়িক কবি। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, অনেক দিন হলো ফেসবুকে কবিতা না-পড়ে লাইক দেয়ার একটি প্রবণতা আমার মধ্যে দেখা দিয়েছে, বিশেষ করে যে-কবিতাগুলিতে আমাকে ট্যাগ করা হয়। না-পড়ে লাইক দেয়াটাকে আমি একনলেজ করা হিসেবেই দেখি, অর্থাৎ কেউ ট্যাগ করলো আর আমি প্রাপ্তি স্বীকার করলাম। যে-কবিতাগুলিতে আমাকে ট্যাগ করা হয় না বা কাউকেই ট্যাগ করা হয় না, সেগুলি আমি স্বাচ্ছন্দ্যে এড়িয়ে যাই সাধারণত। স্বীকার করতে অসুবিধা হচ্ছে না, কারণ আমার ধারণা এই প্রবণতা আমার সমসাময়িক অন্যদের তুলনায় বরং একটু দেরিতেই আমার মধ্যে দেখা দিয়েছে। তারুণ্য বিদূরিত হলে কিছু কিছু আগ্রহ ও অপ্রয়োজনীয় দায়ও বিদূরিত হয় বলেই মনে হচ্ছে। যা হোক, কবিতাগুলি কার লেখা সে-ব্যাপারে অনুমানেই সীমাবদ্ধ থাকতে হচ্ছে, কারণ আমি আমার সমসাময়িক অনেকেরই কবিতার ক্রমবিবর্তনের সাক্ষী নই। আমার বয়স (যদিও খুব বেশি নয়), বাস্তবতা, অভিজ্ঞতা এবং এসবের পারস্পারিক মিথস্ক্রিয়ায় আমি সাক্ষী হয়ে ওঠার ক্ষমতা ইতোমধ্যে হারিয়ে ফেলেছি। যা হোক, যে-কবিতাগুলি পড়লাম, সেগুলি নিঃসন্দেহে পাতে তোলার যোগ্য কবিতা। কবিতাগুলির মধ্যকার সংহতি প্রশংসাযোগ্য। কবিতাগুলি স্বর ও সুরের দিক থেকে মৃদুমন্দ এবং এটিই এই সব কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য এবং এই বৈশিষ্ট্যই ভাষা তৈরি করেছে —ভাষা বলতে ‘ওভারঅল এক্সপ্রেশন’। কখনও বিস্মৃতরূপে, কখন ছিঁটেফোঁটা আকারে এই ভাষার নাগাল আমরা পেয়েছি লোরকা, স্যাঁ জন পার্স প্রমুখ কবিদের কবিতায়। বাংলা কবিতাতেও এই ভাষা দুর্লভ নয়, অন্তত একুশ শতকে। কবির প্রচেষ্টার জায়গাটি স্পষ্টরূপে চিহ্নিত করা যায় এবং সেই জায়গায় তার পর্যাপ্ত অভিনিবেশ রয়েছে। সমকালীন কবিতার বিচারে এই কবিতাগুলির একটি ভালো দিক এর পরিচ্ছন্নতা—ভাব ও ভাষায় পরিশীলিত। মোট সাতটি কবিতা পড়লাম, কবিতাগুলি ‘সিরিজ-কবিতা’ নয়, ফলে ছন্দের বৈচিত্র্য আশা করেছিলাম। সেই প্রাপ্তি বাকি থাকলো এবং বাংলা কবিতার ইতিহাসের প্রেক্ষিতে এই কাব্যপ্রেচেষ্টার গুরুত্ব কতটুকু, সেই আলোচনাও মুলতবি রাখতে হলো, যেহেতু আমার চোখ বাঁধা; একজন কবির কাব্যপ্রচেষ্টার সামান্যই স্পর্শ করা গেল।
—আল ইমরান সিদ্দিকী
সুর
যখন নিভে গেল হারকেনের আলো
তাকে স্পষ্টই দেখতে পেলাম
চাঁদের ঠিক নিচে
করমচা গাছের ছায়ায়—
বাগানের সমস্ত পাতারা জিকিরে রত
বাতাসে লেগে লেগে সে ধ্বনি বহুদূর ছড়ানো
টের পাই আমার ভেতরে
কারো গুনগুন;
পুকুরের স্বচ্ছ প্রদাহ ভেঙে কুচা চিংড়ি
যেভাবে হেঁটে যায় শব্দরহিত,
এমন নিষ্কম্প সময়ে
স্নায়ুভেজা কিছু হাওয়া, কিছু আলো, কিছু সুর
বয়ে এনেছে রাতের মুশায়েরা।
পন্টুনে
দুটি জাহাজের মাঝখানে বৃষ্টি হচ্ছে
পানিরা গায়ে গায়ে লেগে ফুলে উঠছে খুব
সেই ফাঁক ধরে দাঁড়িয়ে আছি
বাকরহিত খুঁটির মতোন;
মূক নগরীর তটে
এক স্মিতবাক পাখি বিমূঢ় হয়ে আছে
কুলিরা-মাঝিরা তামাশা দেখেছে কেবল
পন্টুনে দুপুরের ঘুম দীর্ঘায়িত—
ছোট ছোট ঢেউ হাত বুলিয়ে চলেছে পিঠে
ভেবেছি, এক স্বর্ণতোয়া নদী
কোথাও বেয়ে যায়
আমাদের অভীপ্সার লাল ফুলকা ছুঁয়ে ছুঁয়ে
আভা
মৃত ফুলের ঝাড় থেকে খসে পড়ছে রোদ
এক অনুক্ত দুপুর
মেঘে নিপাট হয়ে আছে;
আমি তার সঙ্গী হই—
এক হতশ্রী গাছের মতো বিগত গানগুলো
গেয়ে চলেছি
ডুবে থাকা বিল কিছু ধ্বনির যোগান দিয়ে যায়,
যখন মন্দ্র মুহূর্ত
ছিন্ন কোনো ঋতু ফুরিয়ে এসেছে এখানে,
যেন খসা ফল
স্রোতে বহুদূর ভেসে গেল;
তার আভাটুকু লেগে আছে এই এখানে—
পাতায়, ডালে, স্মরণঘরের গোলায়।
পরাগ
এই কন্দমূল, গোল গোল পাতা, উজ্জীবনী কোনো সুরে ঘন হয়ে থাকা—
পয়মন্ত কোনো ঋতুর গান।
পরাক্রম লোককথায় মাথা ডোবানো হাঁস—খুঁজে চলে রূপময় মোটিফ।
মহলে মহলে বেজে ওঠে রাগ। ওস্তাদেরা আঙুলে ছড়িয়ে দেন পরাগ।
সুরকণা ভেঙে ভেঙে গড়া এ দেহ।—ঘ্রাণ!
ফিনফিন বয়: ছড়ায়-জংলায়।
তুলে আনি, ডাল নোয়ায়ে ফুল, যেন কেউ রাখে মনে,
সহসা রঙিন হয় গাছ। ঘর থেকে ঘরে, ইত্যবসরে গাঁথা হয় আলো। ঝলমলো—
ঝালরের নিচে গুনগুন আওয়াজ। পাখিকুঞ্জের পাশে যেমন শোনা যায়।
এলো, সহস্র সহচরসহ সাধু।
হলো, গভীর কোনো রান্ধন।
চুলায় বাসনা ওড়ে, বাসনা পুড়িয়ে পুড়িয়ে, কারা যে পেরিয়ে গেলো বন—
আলোক রেখার মতো তারা আচমকাই এসেছিল এই কন্দমূল অধ্যুষিত, এই বহুভঙ্গিম গ্রামে।
সমাধি
ঝুপ করে সে লুকিয়ে পড়লো।
দৃশ্যের সমাধিতে হরিৎ ছায়া।
কাঁপাকাঁপা আলোর কণায় ঝিলমিল ধুলি।
ডাকছে হালের পশু।
আদিম গৃহস্থবাসের পাশে ফুটে আছে
ভুঁইচাপা ফুল, মনোভঙ্গির অনুরক্ত হয়ে।
যে ঘ্রাণ চাই তা এ রকম:
ধ্বনি ও রঙে ধোয়া,
গড়িয়ে চলেছে কোনো ফুলের স্মৃতি
বাসনাবাগান বেয়ে
তারে দেখি নাই
দেখার চেয়ে সে বেশ দর্শনীয়।
হৈম রাগ
এসব হেমন্ত কোথায় ফুটেছে?
কাঁচা হলুদে মাখা;
সেই ডালটিকে নাড়িয়ে দেখি
তট ঘেঁষে যে বেঁকে আছে,
যেন কোনো প্রসারিত হাত
ভেসে থাকা মাছটির ঘ্রাণ ছুঁয়ে
ডেকে এনেছিল মন্দ মন্দ আলো;
ঝোল ঝোল সালুনের ভাঁপে
ঝুপড়ি ঘরের পাশে ছিটকে এসেছে
চূর্ণ কোনো হৈম রাগ,
মন্থরতর দিন
হেলে আছে সবজি চাষের লোলে।
মোহ
সেই পথটা খোলা হলো।
গাছের প্রাচীন ঝাড় বেয়ে যে সরীসৃপ শুয়ে আছে, তার গায়ে রোদ জ্বলছে।
বহুদূর থেকে দেখছি। ফুলের বর্ণিলতার ফাঁকে সেই আলো কেমন মোহ ছড়িয়ে যায়!
যেতে হবে পা টিপে টিপে। পঁচা পাতার গন্ধ গায়ে মেখে।
সমূহ সৌরভ কোথাও ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। তার দিকে ধেয়ে চলেছি।
ঋজু কোনো গাছ উচ্চতার ধারণায় দণ্ডায়মান।
ঘাসের মাথা ছিঁড়ে ছিঁড়ে একটা অপার ছাগশিশু তাকে ঘিরে নেচে ওঠে।
দুপুরের প্রলম্বিত শরীরে বিছিয়ে দিয়েছি ধ্যান।
আলো নিভে আসে। আর ফুটে ওঠে সান্ধ্য লিপিতে ঘনবদ্ধ গান।
পাপড়ি ছিঁড়ে ছিঁড়ে হাওয়া সে সমস্ত বিলিয়ে চলে…