মুসলমানের ছেলে

Posted: ফেব্রুয়ারি ১, ২০২১
Category: কবিতা
By:



তারাদের কথা ওঠে—

ভুলে যাই

একদিন আমারও ছিল বাড়ি

ছোট ছোট পলপলা, কাকরোল ফুলের পাশে
আব্বার নামাজ
মাছের অশ্রুত চোখ

নির্জন ডুমুরের গাছ
পাতার ফাঁকে ফাঁকে
পাখির হদিস—

ভুলে যাই—
চরের নদীর কাছে হাঁটুপানি
দুইটা ঘোড়া
একে অপরের দিকে তাকিয়ে ভাবছে দৌড়

অনন্ত পাটখেত
মাছের ডিমের মতো ফুটছে তারা—

ধুলাচূর্ণের কথা ওঠে—

ভুলে যাই
একদিন আমারও ছিল বাড়ি


তোমাকে হলো না পাওয়া
নিরলে ছোঁয়ার অনুমতি
হঠাৎ পুড়লে ভাত
কারোরই হবে না কোনো ক্ষতি

শার্টের কলার ঠিক
করে দেবে স্বামীর যখন
তাকে বোলো, —চুল খুলে
একবারই পড়ে গিয়েছিল মন

তখন আষাঢ় মাস
বৃষ্টিতে ভিজেছিল হ্রদ
বাড়িতে ফেরার পরে
কাউকেই বলিনি বিশদ—

—শুধু চুনকালি একা
লাগিয়ে ছিলাম নিজ গায়ে—
নদীতীরে কার জামা
ভেসে গিয়েছিল অন্যায়ে—

বোতাম লাগাতে গিয়ে
বলে দিও সবটা যা বাকি
মুসলমানের ছেলে
কবিতা লিখতে পারে নাকি—!


অনেক বছর অনেক মাসের পরে
রাস্তা ধরে হঠাৎ যাওয়ার সময়
স্তব্ধ শহর প্রাচীন যেন খুব
মধ্যযুগের বৃষ্টি তখন হয়

সেই আমাদের অনেককালের দেখা
সেই আমাদের আচমকা এক ভয়
রিক্সা থেকে মেঘদূতমের পথে
যাচ্ছে ভেসে বাক্যবিনিময়—

পাতার পাশেই কাঁপছে ভরা পথ
বৃষ্টি এসে বাধ্য হলো স্নানে
পর্দা টেনে ছুঁই তোমাকে দেখায়
মির্জা গালিব ভিজছে দূরের গানে

সেই তোমাকে টিফিন পিরিয়ডে
ডেকেছিলাম উপপাদ্যের ভুলে
তালার মতোই সহজ ছিল চাবি
নৌকা ডোবে নিরুদ্দেশের কূলে


লেবুর ফুলে একলা হাওয়া
মার্কারি-দিন যায়
জীবনব্যাপী দূরের তুমি
বিষণ্ণতা প্রায়

বৃষ্টি পড়ে, একটা চড়ুই
রেলিঙে এক ফাঁকে
দেখেছে কার চুলের কাঁটা
ঘুমায় বইয়ের তাকে

যোগাযোগের হাওয়ায় কাঁপে
সাঁকোটা উত্তরে
তোমার বাড়ির বাদাম গাছও
আমার লেখা পড়ে—!

কেটলিপোড়া বাষ্পতে ঘ্রাণ
মরীচিকায়, জ্বলো
বাকির টাকার চায়ের মতো
দ্বিধায় টলমলো

অহেতু এই জংশনে কেউ
থামেনি একবার
মানুষ সে তার দূরের ছায়া
সরোদ-পারাপার!


একটা বাউল হারিয়ে ফেলে সুর
লোকাল ট্রেনে, মেলে
বাহির দিকে তাকিয়ে আছে দূরে
মুসলমানের ছেলে—

অন্ধকারের মতন ভীড়ে কেউ
ধইঞ্চাখেতের দিকে
উপচে পড়ে সবুজ রাবার হাওয়া
অন্ধ করণিকের

দাওনি তুমি গোপন দ্বীপের ঢেউ
গাঙের বিষাদ, পাতো
ছেঁড়া বোতাম অন্ধ গহ্বরে
লাগিয়ে দিলে না তো

ট্রেনের থেকে অনন্তদূর মাঠে
ফুঁপিয়ে কাঁদে শাড়ি
ভুলে যেও বাংলা কবিতা ও
মুসলমানের বাড়ি—


কখনো বন্ধুবাড়ি গিয়ে
নিরলে পুছেছো, মরমিয়া
—যে হাত ছুঁয়েছি একদিন
সে ছিল সুন্নি না কি শিয়া—?—

তোমার জামের ফুলে রোদ
খাঁখাঁলীন বুকের হাওয়ায়
সারারাত ভেজে পৃথিবীতে
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়—

আমার গানের কথা বাকি
আজো একা আঙিনায় নিম
দাওনি মেঘের ছায়া যাকে
সে ছিল শুধুই মুসলিম—


কিভাবে যে আসতে পারি ঘরে
সমস্ত পথ অন্ধ, ম্রিয়মাণ
ভাঙলো বাতাস খোঁপায় মূর্চ্ছাহত
আঙুল ভরে ফুটলো অভিমান

কার তালাকের শব্দ হলো দূরে
নতুন বউয়ের ছিঁড়লো শাড়ির পাড়
বাদামগাছের পাতাও যেন কাঁদে
শূন্য হাওয়ায় কিসের অধিকার—?

ভেজা ছাতার সেলাই খুলে গিয়ে
তোমার মুখের উঠল মায়া কেঁপে
হঠাৎ যেন বন্ধ হলো গান
বৃষ্টি এলো সারা জীবনব্যেপে

হাওয়াই মিঠাই রঙ করা সেই জামা
রিক্সা করে রাস্তা পারাপার
গ্রিলের লোহা জাপটে ধরে দেখি
সিঁদুরমাখা পড়ন্ত সংসার—

তোমার হাতে ঘুমায় সেলাইমেশিন
আমার শার্টে শূন্য বোতাম পাতা
বৃষ্টি এলে স্মরণ করে দিও
স্বামীর হাতে নতুন কেনা ছাতা


আধো সকাল। একটা আচ্ছন্ন দুপুরের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে শান্ত বাঁশবন—
অনেক কালের ঝরে যাওয়া পাতা ঈষৎ পাখির ডাকে উড়তে থাকে জঙ্গলে
হতাশা ও বিমমতায়—তার হিংসার সারথীকে এইমাত্র নামিয়ে দিল
উনুনবীথির ছায়ায়—মধ্যাহ্নের নীল স্তব্ধতার ভেতর স্বামীকে ফাঁকি দিয়ে
কেন এলে শেষতক—?

—কে আর কমলাবনের মতো অপেক্ষা করে দূরের বৃষ্টির দিনের! এই যে
শাঁখা, নিঃসঙ্গ বর্মের মতো সিঁদুর, অনতিক্রম্য যে পুনর্লিখন তাকে আমি
এড়িয়ে যাই কী করে!

—তোমার সংসার হলো, আর আমি ঝরা পাতার ক্রম-মর্মতার মধ্যে ডুব
দিয়ে দেখে আসি বিলীয়মান শেষ বিকালের হাওয়া থম মেরে বসে আছে
ডালে ডালে—স্বামীর আড়ালে শুয়ে এখনো কেন কাঁদো! একজন বাউল
আকাশের নিচেই এগিয়ে দিয়েছে ভিক্ষাপাত্র তার দুই মুঠ পূর্ণ করে দিয়ে
দিও পাখির শিস, কলপাড়ে একলা কান্নার ধ্বনি—

—যে গাঙে নামতে পারবে না কোনোদিন সেখানে সাইকেল থামিয়ে কখনো
চেয়ো না তৃষ্ণায় মিঠাপানি!

—তোমারও সংসার হলো, আর আমি দূরের তুষারে দাঁড়িয়ে গথিক গির্জার
বাতি, সন্ধ্যা শেষ প্রায়, স্কিমের ঘর থেকে কে যেন মেশিন পুড়ছে ডিজেলে,
ধূমাভ আলোর মধ্যে বসে আছি মনোলীন, মুসলমানের ছেলে—


তোমাকে পাওয়ার পরে
কেমন হতো সংসার

আমি বকরি চড়াতে পারি—

মাঠের মধ্যের জবাগাছটাকে
বলতে পারি

ফুলে ফুটো, ছলনা করো না—!

১০
মরে গেলে—

কোথাও একটা সাইকেল

থেমে যাবে

হঠাৎ বেলের আওয়াজ

দুপুরের আড়া-জঙ্গল পার হয়ে

ঘুমিয়ে পড়বে

আত্মা ফুলের মায়ায়

খাটিয়ায় শুয়ে শুয়ে মনে হবে

আমিকে ভুলিও না, সোনা

যেতে হয় বলেই

মানুষ সাঁকো বানায় নির্জন বিষণ্ণতার উপর—


হাসান রোবায়েত

জন্ম ১৯ আগস্ট, ১৯৮৯; বগুড়া। শিক্ষা : পুলিশ লাইন্স হাইস্কুল, বগুড়া। সরকারী আজিজুল হক কলেজ; বগুড়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রকাশিত বই —

ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে [কবিতা; চৈতন্য, ২০১৬]
ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে [ভারতীয় সংস্করণ, বৈভাষিক, ২০১৮]
মীনগন্ধের তারা [কবিতা; জেব্রাক্রসিং, ২০১৮]
আনোখা নদী [কবিতা; তবুও প্রয়াস, কলকাতা, ২০১৮]
এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে [কবিতা; ঢাকাপ্রকাশ, ২০১৮]
মাধুডাঙাতীরে [কবিতা; ঐতিহ্য, ২০২০]

ই-মেইল : hrobayet2676@gmail.com

শেয়ার করুন

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts

Begin typing your search term above and press enter to search. Press ESC to cancel.

Back To Top
error: Content is protected !!