মুজিব ইরম-এর কবিতা

Posted: ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২১
Category: কবিতা
By:


শিম মৌসুমের কবিতা

রথের দিনে শিমের বিচি গাঁথিয়া দিও সাঁঝে, সেই বিচিতে উঠবে গাছ আমার মনের মাঝে। শিমের গাছে ভরে উঠবে তোমার নয়া ভিটা, সকাল বিকাল মায়ার হাতে দিবা জলের ছিটা। আমি না হয় দূরে বসে দেখবো তোমার কাজ, তোমার হাতে আমিই না হয় ধরবো সবুজ সাজ। কতো কতো ফুল ফুটিবে তোমার আদর পেয়ে, কতো কতো আসবে ভ্রমর ফুলের খবর পেয়ে। ফুলগুলো তো সকাল বিকাল তোমার দয়ায় ফোটে, তুমিও যেনো ফুইটা থাকো মিথ্যে তো নয় মোটে। আমি না হয় শিমের ছায়ায় খুব নিরলে বসে, দেখবো শুধু কেমন করে পাঁপড়িগুলো খসে। সেই না ফলন তুলিয়া নিও তোমার আঁচল ভরে, দেখবো আমি দূরের মানুষ সারা মৌসুম ধরে। সেই শিম রান্ধিবা তুমি দাওয়াত পাইবার আশে, মেকুর হইয়া বইস্যা থাকমু তোমার ঘরের পাশে।

কী আর আমি কইমু কন্যা কী আর আমি কইমু, বছর বছর শিমের ছায়ায় বইস্যা আমি রইমু। আমার কথা রাইখো কন্যা আমার কথা রাইখো, সকাল বিকাল একটু আদর একটু হাসি মাইখো।

পাঁচমিশালি কবিতা

তোমার রান্নাঘরের পাশে পুদিনা পাতার গাছ, সেই পুদিনা তুলিয়া রাঁধো ডিমাল পুঁটি মাছ। সেই সালনের স্বাদেগন্ধে কতো মানুষ মজে, আমিও মজি শব্দসুরে তোমার নামটি ভজে। তোমার রান্নাঘরের পাশে ঝিঙে করো চাষ, সেই ঝিঙে ঝাড়ের ফুলে আমার বসবাস। আমার বসবাস গো কন্যা তোমার নামের মাঝে, তোমার শাড়ি চুড়ির শব্দে মনটি আমার বাজে। তোমার ঘরের পাশে ফলাও চিকন মরিচ গাছ, বরোমাইস্যা মরিচ ধরে নীল সাদা ফুল সাজ। যেমন জবা ফুইটা থাকে তেমন আমার হাল, তোমায় আমি তেমন দেখি যেমন জবা লাল। সফরি গাছের ছায়ায় গো কন্যা তোমার রান্নাঘর, কতো সফরি ধইরা আছে কইরা আমায় পর। তোমার রান্নাঘরের পাশে লেবু গাছের ঝোপে, কতো লেবু ধইরা আছে স্পর্শ পাবার লোভে। সফেদা গাছের ডালে গো কন্যা কাঁঠাল গাছের তলে, রাত্রি হলে চক্ষু আমার জোনাক হয়ে জ্বলে।

ডালিম গাছে ধরে আভা ফল পাকিবার কালে, আমি তোমার দইরল পাখি বেগুন গাছের ডালে। গাইতে গাইতে ভাঙ্গি গলা কলিজা কাটা সুরে, গেন্ডা হইয়া ফুইটা থাকি কুয়াশা ভিজা ভোরে।

ধান মৌসুমের কবিতা

তোমার বাড়ির পাশে এবার ধানের কলরব, ধান পাকিছে মন মজিছে রং ধরিছে সব। ধান তুলো ধান তুলো কন্যা আউলাইল মাথার কেশ, তোমার দেহে উঠুক ফুটে ফসল তোলার রেশ।

উড়াও ধানের চিটা তুমি সেই না হাতের বায়, সেই চিটা উড়িয়া এসে লাগুক আমার গায়। তোমার বাড়ির বাতাস আসুক আমার বাড়ি দিয়া, উড়ানিয়া বাতাস ফিরুক তোমার গন্ধ নিয়া।

ধানে দিচ্ছ উনা তুমি উঠবে ঘরে চাল, সেই আগুনের পরশ লেগে রাঙ্গা হচ্ছে গাল। ভাদ্র মাসের উমতানিতে শরীর হৈলো কালা, তুমি বড়ো মন সুন্দরী তুমি বড়ো ভালা।

এই ধান তুলিয়া কন্যা খাওয়াইবায় আর কারে, ইরম সে তো মাঠের মানুষ ডাইকো তুমি তারে। তুমি তারে দাওয়াত দিও ফসল তোলার দিনে, সে তোমারে রাখবে মনে জন্মমৃত্যু ঋণে।

আরও ১টি দেশি কবিতা

একটি ফুলের মালা তুমি গাইথো আমার তরে, সেই না ফুলের গন্ধ তুমি ছিটিও তোমার ঘরে। সেই মালাতে তোমার আমার মিলন মেলা হয়, সেই ঘরেতে আশিক মাশুক ভাবের ঘোরে রয়।

তাজা ফুলের মালা কেনো বাসি হইবো আর, যার তরেতে গাঁথবে মালা নাম জপিও তার। সেও তোমার নাম জপিবে যদি মায়া পায়, সেই না সুখে নিদ্র্রা যাবে ফুলের বিছানায়।

এই না ফুলের বাহার রূপে এই না ফুলের বাসে, তোমার স্পর্শে ফুল ফুটিবে শুকনা ঘাসে ঘাসে। বাগানগুলো উঠবে ভরে নানা পারিজাতে, গন্ধ দিয়ে ঘুম ভাঙ্গাবে পুষ্পফোটা প্রাতে।

এ-তো ফুলের মালা নয় গো নামের মালা হয়, নামে নামে গাইথো মালা শুধু বন্ধুময়। সেই মালা পরিতে গলে ইরম করে আশা, আশিক যেমন মাশুক সনে নিত্য খেলে পাশা।

গীত বাঁধিবার কারণ

তোমার কথা লিখছি কন্যা তোমার বাড়ি লিখছি, লিখতে লিখতে তোমার কথা গান বাঁধিবার শিখছি। একটা জীবন যাচ্ছে কেটে তোমায় জপে জপে, গাইতে গাইতে ভাঙ্গছি গলা সুর বাঁধিবো কবে।

সবুজ সবুজ ধানের জমি দুই পাশেতে নিয়া, থমকে থাকে মাটির সড়ক একটু মোচড় দিয়া। সেই না পথে মিশলো গিয়া তোমার বাড়ির পথ, সেই বাড়িটি গাইতে গিয়া চাইছি মতামত।

যদি তুমি দাও গো কন্যা তোমার মতামত, সুর বাঁধিমু গীত বাঁধিমু ধরমু তোমার পথ। সেই না আশায় দাঁড়িয়ে থাকি একলা একটা গাছ, দেখি বসে মাঠের মাঝে জোড়া পাখির নাচ।

ফুল ফুটেছে মন ফুটেছে তোমার ঘরের পাশে, ফল ধরিবে ফল পাকিবে থাকি আশার আশে। কতো না ফল পাইকা থাকবো রঙ মাখিয়া বুকে, কতো পাখি যাইবো ফিরে তৃপ্তি চোখে মুখে।

আমার বড়ো মন্দ কপাল তোমার বাড়ির পাশে, ঘুরতে থাকি ঘুরতে থাকি পাড়াপড়শি হাসে। ইরম কী আর মাখবে গাঁয়ে লোক নিন্দার ভয়, তোমার দয়া পাইলে হবে এই না গীতের জয়।


মুজিব ইরম

কবি ও কথাসাহিত্যিক
জন্ম মৌলভীবাজার জেলার নালিহুরী গ্রামে। পারিবারিক সূত্র মতে ১৯৬৯, সনদপত্রে ১৯৭১। পড়াশোনা করেছেন সিলেট, ঢাকা ও যুক্তরাজ্যে। তাঁর ১ম কবিতার বই মুজিব ইরম ভনে শোনে কাব্যবান  প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ সালে, বাংলা একাডেমি থেকে। তাঁর প্রকাশিত অন্যান্য কবিতার বইগুলো হচ্ছে: ইরমকথা ১৯৯৯, ইরমকথার পরের কথা ২০০১, ইতা আমি লিখে রাখি ২০০৫, উত্তরবিরহচরিত ২০০৬, সাং নালিহুরী ২০০৭, শ্রী ২০০৮, আদিপুস্তক ২০১০, লালবই ২০১১, নির্ণয় ন জানি ২০১২, কবিবংশ ২০১৪, শ্রীহট্টকীর্তন ২০১৬, চম্পূকাব্য ২০১৭, আমার নাম মুজিব ইরম আমি একটি কবিতা বলবো ২০১৮। পাঠ্যবই ২০১৯, পয়ারপুস্তক ২০২০, দেশি কবিতা ২০২১। কবিতা ছাড়াও মুজিব ইরম কাজ করেছেন গল্পে, উপন্যাসে, শিশুসাহিত্যে। তাঁর প্রকাশিত উপন্যাস/আউটবই: বারকি ২০১১, মায়াপীর ২০০৯, বাগিচাবাজার ২০১৫। গল্পগ্রন্থ: বাওফোটা ২০১৫। শিশুসাহিত্য: এক যে ছিলো শীত ও অন্যান্য গপ ২০১৬। মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস: জয় বাংলা ২০১৭। এছাড়া প্রকাশিত হয়েছেইরমসংহিতা ২০১৩, ভাইবে মুজিব ইরম বলে ২০১৩, পয়েমস অব মুজিব ইরম ২০১৪, উপন্যাসসমগ্র: মুজিব ইরম প্রণীত আউটবই সংগ্রহ ২০১৬, প্রেমের কবিতা ২০১৮, শ্রেষ্ঠ কবিতা ২০১৮, ইরম পদাবলি ২০২০, নীহারিকা প্রকাশন ত্রিপুরা থেকে: মু.ই ২০২০, তুলসী পাবলিশিং হাউস আগরতলা থেকে: নির্বাচিত কবিতা ২০২১

পুরস্কার: মুজিব ইরম ভনে শোনে কাব্যবান গ্রন্থের জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি তরুণ লেখক প্রকল্প পুরস্কার ১৯৯৬। বাংলা কবিতায় সার্বিক অবদানের জন্য পেয়েছেন সংহতি সাহিত্য পদক ২০০৯, কবি দিলওয়ার সাহিত্য পুরস্কার ২০১৪। কবিবংশ গ্রন্থের জন্য পেয়েছেন ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার ২০১৪। শ্রীহট্টকীর্তন গ্রন্থের জন্য পেয়েছেন সিটি-আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার ২০১৬। মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস জয় বাংলা’র জন্য পেয়েছেন এম নুরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার ২০১৭। কবিতা ও কথাসাহিত্যে সার্বিক অবদানের জন্য পেয়েছেন শালুক সাহিত্য পুরস্কার ২০১৯। এছাড়া পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ পুরস্কার ২০১৭।

শেয়ার করুন

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts

Begin typing your search term above and press enter to search. Press ESC to cancel.

Back To Top
error: Content is protected !!