মিছিল খন্দকারের কবিতা

Posted: ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২১
Category: কবিতা
By:


আ-মরি কবিতা

কী যে সমীরণ, বাঁকা বায়ু বয়, আহা!
যাহাই কুহেলি, কুয়াশাও নাকি তাহা!

সতত সে তপে; ভ্রান্তি-ছলনে ফেলে
যেন মোরা কোনো সাগরদাঁড়ির ছেলে!

আজি শ্যাম-হিয়া উথলি পরানে মেশে
জোড়াসাঁকো থেকে বজরা এসেছে ভেসে?

রণে যবে মম ক্লান্ত বাঁশরি দ্যাখো,
একা পড়ে আছি আসানসোলের সাঁকো।

ঢের দিন হায় কাটিয়ে চিলের দলে
হয়তো মরব যে-কোনো ট্রামের তলে!

সম্মুখে হেরি মাস্তুলে পাঞ্জেরি—
শীতে-কুয়াশায় নোঙরে রয়েছে ফেরি।

নাঙা পদধ্বনি, দিগন্তে চলে উট—
ধস্ত নীলিমা লিখে গেছে চিরকুট।

ওদিকে আয়শা মক্তব থেকে ফেরে
চুল খোলা রোদে ঘাঁই মারে মাছ ঘের-এ।

যে স্মিত দৃশ্যে রক্তিম হলে ফল,
রসালো ভুট্টা—বসে পড়ে চঞ্চল।

দুপুর নীরবে তাকায় হালিক-টোনে
‘নাও, মেগ খাও’, বলে কালিদাস ফোনে।

আমি কিনা সব খুঁটিয়ে খাওয়ার কূলে—
প্যারাসুট তেল মাখি কুন্তলে-চুলে।

পারাপারহীন সাঁকো

ফুলের বাগানে এত এত ফুল ফোটে
আমার তো তবু লাগছে না ভালো মোটে।

চারপাশ থেকে প্রাণ ধরে টানে কারা?
কিন্তু বিকেলে নিসঙ্গ ছিল পাড়া!

কেউ যেন ডাকে, ইশারায় বলে, আয়।
যাব কি না ভাবি, অন্যরা চলে যায়।

কে যে ফিসফিস, কার সাথে করে রতি!
জামগাছ হলো শিরীষগাছের পতি।

চাকা পাংচার, থেমে আছে গাড়ি মোড়ে—
কার ছেঁড়া ঘুড়ি ভিন ছাদে গিয়ে ওড়ে!

ছিঁড়ে ফেলা চিঠি বাতাসে উড়ছে, দেখি
কোন বুকে ধান ভেনে চলে কার ঢেঁকি!

ঘরে নেই সাড়া, ঝুলে আছে তালা দ্বারে—
সবাই কয়েদি, সকলেই কারাগারে।

মৌচাক থেকে মধু নিয়ে যাও তুলে,
রেখে আসো মাছি সেইসব ফুলে ফুলে।

দেখা

ধনুক ব্রিজের ঢালে
নিসঙ্গ একটা পথ
নিজেকে দুই ভাগ করে চলে গেছে,
পৃথিবীর উত্তর ও দক্ষিণ অভিমুখে।
এই দৃশ্যই উলটো করে দেখি—
ভুবনের দুই প্রান্ত থেকে
দুটি পথ এসে
এক হয়ে বয়ে গেছে পশ্চিমে।
যেন, অশান্ত কেউ
চলে গেছে
নিজেকে দুই ভাগ করে দিতে দিতে,
কিংবা বিভক্ত কেউ
দূরবর্তী দুই দিক থেকে এসে
এক হয়ে এগিয়ে চলেছে
বিপরীতে।

কথা বলো তার সাথে

নোঙর করে রাখা একা এক বালুর জাহাজ
কী প্রত্যাশা করে তোমার কাছে;
সন্ধ্যায়—
যখন নদীতে হাহাকারের মতো কুয়াশা নেমে আসে।
একটা গাঙচিল ডানা না ভিজিয়েই
নদীর পানি ঘেঁষে
ঠিক সমান্তরালভাবে উড়ে যায়।
অথবা সে যায় না কোথাও,
ফিরে আসে।
যখন মাগরিবের আজানকেও
মুয়াজ্জিনের নিরুপায় কান্নাধ্বনি মনে হয়।
বিদ্যুতের সুইচ টিপে হতাশ হয়ে
কাঁপা কাঁপা হাতে মোম ধরায় আমাদের মা।

এক বন্ধুর নির্জন সেলুনে বসে
পুরোনো পত্রিকা পড়ে
গ্র্যাজুয়েট বেকার বন্ধুটা।
পেটে প্রেমিকের অযাচিত ভ্রূণ নিয়ে
তোমার পছন্দ যখন
বর্ষাকবলিত চোখে
ছাদে বসে গোপন সুরাহা খোঁজে।
তখন তুমি যাও,
গিয়ে বসো ওই বালুর জাহাজে
পা ঠুকে ঠুকে মৃদু, কথা বলো তার সাথে।
সে চায় তোমাকে
পাড়ের প্রসঙ্গে শোনাতে।

অরণ্যস্বভাব

সন্ধ্যার মন্থর আলো নদীতে ভাসতে থাকবে। ক্রমে এ মানবশরীর রূপান্তরিত হবে রাতে। মিশে যাবে চেনা কুয়াশায়। দূর থেকে বাসের গর্জন শোনা যাবে। যেন কাছেই লোকালয়। হাইওয়ে। অথচ মনে হবে পৃথিবী তো চিরকাল জনহীন ছিল। ছুটে চলা গাড়ির ধাতব ইঞ্জিন যে শব্দ করে, বনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তা পাবে অরণ্যস্বভাব, যেন শিকারকে লক্ষ্য করে ছুটে যাওয়ার কালে কোনো অদেখা পশুর কেশর বেজে চলছে বাতাসে। এসবের মধ্যে বসে কিছুটা ভয় আর তন্দ্রাভাব নিয়ে নিজের ভেতরে তাকিয়ে বলব, চাই। বৃষ্টি নেমে আসবে সহসাই!

পৃথিবীব্যাপিয়া এসেছে নিদ্রা

যেন—
তোমার কিছুই নাই কোনোখানে
বেবাক অন্ধকার!
থই থই নদী দূরে চলে যায়
সঙ্গে চলছে পাড়।
রাগী স্রোত তার তীব্র লাথিতে
যতো পারে পাড় ভাঙে,
ভাতার যখন বুঝলো না আর
কতোটা বুঝবে লাঙে!
নিজেও বোঝো না নিজেকে ততোটা
ব্যথা টুং টাং দিলে—
এখানে তোমার ছিল সামান্য
সেখানে কিছুটা ছিলে।
ছড়ানো নিজেকে কুড়াতে নেমেছো
পাচ্ছো না সব খুঁজে—
পৃথিবীব্যাপিয়া এসেছে নিদ্রা
তুমি আছো চোখ বুজে।

ডর

পৃথিবীতে
এমনই তো বৃষ্টি নামে
দুপুর তাতে—
একটা হাতের কাক্সক্ষা করে
দিন চলে যায় অন্য হাতের।
পথও যাচ্ছে ডুবে, এমন বারিধারা
বুকের মধ্যে বেড়ে উঠছে
রুগ্ন নিমের চারা।
ঝাপ্টা লাগে, পাপটা লাগে,
দাগ থেকে যায় ঠোঁটে—
রৌদ্র ছিল, মেঘ হয়েছে,
আবার রৌদ্র ওঠেন।
উঠতে গিয়ে পিছলে পড়ে
হচ্ছে এমনতরো,
বলতে গিয়ে থাকছে কিছু
সবটা বলার পরও।
বলার যেন দরকারই নেই,
ভাত তো আছে, তরকারি নেই;
এমন যখন হয়—
একটা ভয়কে ডর দেখাচ্ছে
অন্য একটা ভয়!

মায়ের কবর

গাঢ় শীত রাতে আমি কবরস্থানের দিকে বয়ে যেতে থাকি।
ভাবি, যে কোনো ভাঙা কবরে ঢুকে দেব নিরীহ ঘুম,
কিংবা আদতে ঘুমাতে পারি কিনা; দেখি।
পথে ভাবনার দিক বদলায়।
আর পরিজন হাওয়া—কেমন ঠান্ডা হাত তার,
যেন ইয়ার্কি করে তার ভেজা হিম করতল
শরীরে ঢুকিয়ে দেয়।
আর গাছে গাছে শিরশির করে ওঠে পাতা।
এসব গাছ সব মৃতদের সুহৃদ
কবরের আশপাশে সন্ত ভূমিকায় দাঁড়ানো।
যে কোনো কবরের পাশে গাছের লাইনে দাঁড়িয়ে আমি,
পাঠ করি নিজের কিংবা পছন্দসই যে কারও কবিতা।
কার যে কলধ্বনি আমার ভেতরে তখন হু হু করে বাজে,
সামান্য পরিচিত লাগে কিংবা লাগে না,
নাকি বাতাসের কারসাজি
দূরাগত যে কোনো সংকেত?

যে কোনো কবরকে আসলে আমার
মায়ের কবর মনে হয়!

মৃত্যুর পরে লেখা

নিজের কবর আমি নিজেই খুঁড়েছিরে মিথুন।
আর শরীরে আগুন ধরিয়ে তাতে
ঢুকে পড়েছি,
শীতে মানুষ যেভাবে ঢোকে লেপের ভেতরে।
তখন হয়তো শ্রাবণ মাসের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে
জলে ও পিতলে, গির্জার ঘণ্টাধ্বনিতে,
সাবলীল সন্ধ্যার টিনে,
বর্ষার আঁচে গলে যাওয়া উঠানে,
ভেসে ওঠা আনত কোনো গ্রামে।
পানিতে পূর্ণিমা চাঁদ খুটে খাচ্ছে মাছ,
বৃষ্টির তবলা ধ্বনি মিশে যাচ্ছে মোয়াজ্জিনের আজানে।
আর এদিকে, অভ্যাসবশত বৃষ্টি ভিজতে ভিজতে
জ্বর বাধিয়েছে আমার কংকাল।
আমাদের জাগতিক স্মৃতি জ্বলে উঠছে
মেঘের মলাটে, বিদ্যুতে।
জীবনের ঝাল হাসছে
বজ্রপাতের নিনাদে।
তখন অত রাতে, বৃষ্টিতে একা একা
তুই বোকা
কী করছিস ছাদে!

যথেষ্ট নেশা রাখা হবে

নদীতে সাঁতার জমা দিয়ে তীরে উঠে আসুন তাহলে
নারীরা যদিবা পড়ে পুরুষের দিকে আজ ঢলে
কোলে তুলে নিন
বেলুন উড়িয়ে দিন
পরে সব আকাশ একে একে নিয়ে ফিরবেন
অন্যমনস্করা তার আগে লাগান নিজ নিজ প্যান্টের চেন।
সবার সকল দাবি মেনে নেওয়া হলো।
সতেরোর পর হবে ষোল।
খেলা হবে। খেলা শেষে রবে নারকোলও।
মদের মধ্যে যথেষ্ট নেশা রাখা হবে জারি
অতল সংকট থেকে উঠে আসা হাসিরা পাবে পিচকারি।
পৃথিবীর সব অশান্তি জ্বালিয়ে রান্না হবে
খাওয়া শেষে ভাতঘুম হবে
সবাই বাস্তু পাবে
মেঘ দিয়ে জানলা-কবাট হবে, রোদ দিয়ে আসবাব আর
জোৎস্না দিয়ে হবে ঘরদোর।
যে যার বাড়ি ফিরতে পছন্দমতো পাবে রাত, দুপুর, সন্ধ্যা বা ভোর।


মিছিল খন্দকার

কবি
জন্ম: ২০ ডিসেম্বর; খেজুরা, বাকেরগঞ্জ, বরিশাল। স্নাতকোত্তর (অর্থনীতি)।
প্রকাশিত কবিতার বই:
মেঘ সামান্য হাসো [ঐতিহ্য, ২০১‌৫]
পুষ্প আপনার জন্য ফোটে [জেব্রাক্রসিং, ২০১৮ ও বৈভব সংস্করণ, ২০২০]
আকাশ চাপা পড়ে মরে যেতে পারি [বাতিঘর, ২০২০]
ই-মেইল : michhilkr@gmail.com

শেয়ার করুন

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts

Begin typing your search term above and press enter to search. Press ESC to cancel.

Back To Top
error: Content is protected !!