
উপন্যাস মানে তো বাস্তবতার প্রতিবেদন নয়। বাস্তবতার প্রতিবেদন সংবাদপত্রে হতে পারে। উপন্যাসে কল্পনাশক্তির ব্যবহার আবশ্যক। বড় ঔপন্যাসিকরাই কল্পনাশক্তির যথার্থ ব্যবহার করতে পারেন। ঔপন্যাসিককে বাস্তবতার রুক্ষতায় সাহিত্যের রস জারিত করতে হয়। ‘উজানবাঁশি’ উপন্যাসে আমি উড়িয়ে দিয়েছি কল্পনার বিস্তর ফানুস। জ্ঞান ও নির্জ্ঞানের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছি বড় একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন। গ্রামের যে মানুষটি শস্য উৎপাদন করছে, তার তো পুথিগত বিদ্যা নেই। আমরা হোমার-দান্তে পড়ি, তলস্তয়-দস্তয়ভস্কি পড়ি, জীবনানন্দ-মার্কেজ পড়ি। কিন্তু সেই মানুষটি হয়তো মার্কেজের নামই শোনেনি। তার মানে কি সে নির্জ্ঞান অবস্থায় বিরাজ করছে? কেন সাংস্কৃতিক সংকট, কেন সহিষ্ণুতার অভাব, তা খুঁজতে বাংলার সমাজের গভীরে চালিয়ে দিয়েছি মস্ত এক লাঙল। তবে সেই লাঙল প্রকট নয়, অদৃশ্য।
মিথ বা লোকপুরাণকে আমি কথাসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান বলে মনে করি। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে এত এত মিথ ছড়িয়ে আছে যে, কখনো কখনো মনে হয় গোটা দেশটাই একটা মিথের কূপ। মিথের সঙ্গে এখানকার মানুষের বসবাস। তারা মিথ সৃষ্টি করেন, মিথ যাপন করেন, মিথে আনন্দ লাভ করেন, মিথে শাসিতও হন। বাংলায় যত মিথ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, প্রত্যেকটি দিয়ে একেকটি উপন্যাস রচনা সম্ভব, গল্প রচনা সম্ভব। আমাদের ঔপন্যাসিকরা যে তাঁদের উপন্যাসে মিথের ব্যবহার করেননি, তা নয়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’য় দেখি মিথের সফল ব্যবহার। কাৎলাহার বিলের ধারে ঘন জঙ্গল সাফ করে বাঘের ঘাড়ে জোয়াল চাপিয়ে আবাদ শুরু করার দিনের এক বিকেলবেলায় মজনু শাহর অগুনতি ফকিরের সঙ্গে মহাস্থানগড়ের দিকে যাওয়ার সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেপাই সর্দার টেলারের গুলিতে মারা পড়ে মুনশি বয়তুল্লাহ শাহ। কাৎলাহার বিলের দুই ধারের গিরিরডাঙা ও নিজগিরির ডাঙার মানুষ সবাই জানে, বিলের উত্তরে পাকুড়গাছে আসন নিয়ে রাতভর বিল শাসন করে মুনশি।
এই যে বাঘের ঘাড়ে জোয়াল চাপিয়ে আবাদ শুরু করা, এটা মিথ। মুনশি বয়তুল্লাহ যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেপাই সর্দারে গুলিতে মারা পড়েছিলেন, এটা বাস্তব; ঐতিহাসিক সত্য। আবার কাৎলাহার বিলের উত্তরে পাকুড়গাছে আসন নিয়ে যে তিনি বিল শাসন করেন, এটা মিথ। অর্থাৎ একই জনপদে মিথ ও বাস্তবতা পাশাপাশি বসবাস করছে। এই মিথকে মানুষ পুরোপুরি বিশ্বাস করে না, আবার পুরোপুরি অবিশ্বাসও করে না। বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের মধ্যবর্তী স্থানে মিথের বসবাস। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁর কৌশলী হাতে মিথ ও বাস্তবতার মিশেলে এক অসাধারণ শিল্প সৃষ্টি করেছেন, যার নাম ‘খোয়াবনামা’।

ধরণ : উপন্যাস
লেখক : স্বকৃত নোমান
প্রচ্ছদ : রাজীব রাজু
প্রকাশক : পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০২১
গায়ের মূল্য : ৭৫০ টাকা
আমি প্রচুর ভ্রমণ করি। সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ি। যেখানেই ঘুরতে যাই কোনো না কোনো মিথের সঙ্গে পরিচিত হই। যেন আমি সেসব মিথের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্যই এখানে এসেছি। যেন মিথেরা আমার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্যই এতকাল অপেক্ষা করছিল। একবার বাংলাদেশের দক্ষিণের দ্বীপ চর কুকুরি মুকরি ভ্রমণে গেলাম। ওই দ্বীপে ইসলামি শরিয়তের কঠোর অনুশাসন বিদ্যমান। কিন্তু শরিয়তকে চাপিয়ে এক মিথ বিরাজ করছে সেখানে। কালাপীর নামক এক অদৃশ্য সত্তার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে চলে অধিকাংশ মানুষ। চর কুকরি মুকরির মানুষদের সুখে-দুঃখে থাকেন কালাপীর। তার ভয়ে এই চরে কেউ চুরি-ডাকাতি করার সাহস পায় না। যদি কেউ খারাপ কাজ করে, সঙ্গে সঙ্গে সেই কাজের প্রতিফল পেতে শুরু করে। কালাপীর তাকে শাস্তি দেন। তার শাস্তির ভয়ে এই চরের কেউ কারো সঙ্গে ঝগড়া-ফ্যাসাদ করে না। কোনো অপরাধ সংঘটিত হয় না। স্বাধীনতার পর এই চরে একটা খুনের ঘটনাও ঘটেনি। শালিস-দরবারও হয় না খুব একটা। একটা পুলিশ ফাঁড়ি আছে, কিন্তু গ্রেফতারের মতো কোনো আসামি খুঁজে পায় না পুলিশ। পরবর্তীকালে এই মিথ নিয়ে ‘কালাপীর’ নামে একটি গল্প লিখি, যা আমার ‘বানিশান্তার মেয়ে’ গল্পগ্রন্থে রয়েছে।
এমনই একটি মিথের কথা জানতাম বহু বছর আগ থেকে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এক এলাকায় এমনই এক মানুষ ছিলেন, শৈশবে যাকে বাঘে গিলে ফেলেছিল, চল্লিশ বছর যিনি বাঘের পেটে ছিলেন, চল্লিশ বছর পর বাঘ যাকে উগরে দিয়েছিল। আমার শৈশবে মানুষটিকে দেখেছিও। সবসময় নেংটা থাকতেন। তীব্র শীতেও কিছু গায়ে দিতেন না। সবাই তার নাম দেয় বাঘামামা। সবাই তাকে পীর সাব্যস্ত করে। তার অলৌকিক কর্মকাণ্ডের কথা ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে। মৃত্যুর পর তার সমাধিক্ষেত্রে মাজার ওঠে। প্রতি বছর ওরস হয়। শত শত মানুষ জমায়েত হয়। হিন্দু-মুসলমান সবাই। প্রসাদ হিসেবে খিঁচুড়ি-মাংস খায়।
বাঘামামার চল্লিশ বছর বাঘের পেটে থাকার মিথটি জানি, কিন্তু এটা নিয়ে কখনো সিরিয়াসলি ভাবিনি। কখনো মনেই আসেনি এটা নিয়ে কোনো গল্প-উপন্যাস রচিত হতে পারে। ২০১৭ সালের কোনো একদিন, যখন আমি ‘মায়ামুকুট’ উপন্যাসটি লিখছি, হঠাৎ মনে পড়ে গেল বাঘামামার মিথটি। মনে হলো এই মিথ নিয়ে তো একটি উপন্যাস হতে পারে! কী আশ্চর্য গল্প! চল্লিশ বছর কিনা একটা মানুষ বাঘের পেটে ছিল! খুবই উত্তেজনা অনুভব করলাম। পরের বছরের ডিসেম্বরে শুরু করে দিলাম লেখা। চেষ্টা করি প্রতিদিন একটু একটু করে লিখতে। কিন্তু প্রতিদিন কি আর লেখা হয়? কোনো কোনো দিন শুধুই ভাবি, লিখি না। কোনো কোনোদিন লেখার চেষ্টা করি, কিন্তু লেখা হয় না। আবার কোনো কোনো দিন এক টানে লিখে ফেলছি পাঁচ শ বা এক হাজার বা দুই হাজার শব্দ। এভাবে একটু একটু করে লিখতে লিখতে কেটে গেল ২০১৯ সাল। কিন্তু উপন্যাস শেষ হচ্ছে না। আখ্যান দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। শেষ করতে পারছি না। যখনই ভাবি এখানে শেষ করে দেব, তখনই মনে হয়, না, এখানে শেষ করলে হবে না, অপূর্ণ থেকে যাবে; আরো একটি পর্ব লেখা দরকার।
২০২০ এর মার্চে এসে দেখি পাণ্ডুলিপির শব্দসংখ্যায় দাঁড়িয়েছে প্রায় এক লাখ ৩২ হাজার। মার্চের শেষে দেশে শুরু হয়ে গেল করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের লকডাউন। অফিস বন্ধ, আড্ডা বন্ধ। আমারও অখণ্ড অবসর। এই অবসরটাকে কাজে লাগাতে চাইলাম। পাণ্ডুলিপিটির প্রিন্ট নিলাম। শুরু করলাম এডিট। প্রথম এডিটে বাদ পড়ল প্রায় ২৭ হাজার শব্দ। প্রথম দফায় এডিট শেষ করে আবার প্রিন্ট নিলাম। এবারও কিছু বাদ পড়ল এবং যোগ হলো। সেপ্টেম্বরের ১৬ তারিখে যখন পাণ্ডুলিপির সম্পূর্ণ সম্পাদনা শেষ করি, তখন দেখি, এবার শব্দ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় এক লাখ ১১ হাজার।
এডিট করতে করতে রীতিমতো বিরক্তি ধরে গেছে। বড় ক্লান্ত। পাণ্ডুলিপিতে আর হাত দিতে ইচ্ছে করছে না। বুঝলাম, এই পাণ্ডুলিপি এডিট করার মতো আর কিছু নেই। অন্তত আমার পক্ষ থেকে আর কিছু এডিট করার নেই। এডিট সম্ভব কোনো দক্ষ এডিটরের পক্ষে। প্রত্যেক উপন্যাস লেখার সময় আমি এমনটাই করি। এডিট করতে করতে যখন স্বতঃস্ফূর্ততা নষ্ট হয়ে যায়, যখন বিরক্তি চলে আসে, তখন বুঝি পাণ্ডুলিপি সম্পূর্ণ হয়েছে, আর সংযোজন-বিয়োজন করার কিছু নেই। ‘উজানবাঁশি’র ক্ষেত্রেও তাই ঘটল।
শুরুতে যে মিথ বা লোকপুরাণের কথা বললাম, তাতে যে কারো মনে হতে পারে, ‘উজানবাঁশি’ সম্ভবত মিথ কেন্দ্রিক উপন্যাস। মোটেই তা নয়। ‘উজানবাঁশি’তে মিথ ব্যবহার হয়েছে ঠিক ততটুকু, যতটুকু ডিমান্ড করেছে আখ্যান। প্রধান চরিত্র বাঘামামার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে আরও অনেক চরিত্র। যেমন উজানগাঁর ভূস্বামী অনাদি দত্ত, দেখতে যিনি অবিকল রবীন্দ্রনাথ, যিনি রবীন্দ্রনাথের মতোই আলখাল্লা পরেন, রবীন্দ্রনাথের মতোই তার মাথার চুল, মুখের দাঁড়িগোঁফ। যেমন মাওলানা আবদুল কয়েদ, যিনি উজানগাঁয়ের সর্বজন মান্য ব্যক্তিত্ব। তিনি বাঘামামাকে নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, মানুষ কি চল্লিশ বছর বাঘের পেটে থাকতে পারে? একদিন মাটি খুঁড়তে গিয়ে কায়েদ মাওলানা আবিষ্কার করেন এক প্রাচীন শিলালিপি। সেই শিলালিপির লিপিকে ঘিরে মোড় নেয় আখ্যান। শরিয়ত পন্থা থেকে মারেফত বা আধ্যাত্মবাদের দিকে ধাবিত হন কায়েদ মাওলানা। তার পুত্র মোহন রেজা, যার গায়ে ভেসে বেড়ায় বুনো কলমির ঘ্রাণ, ঘুমে-জাগরণে যে শুনতে পায় হট্টিটি পাখির ডাক, প্রাচীন শিলালিপির বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে সে শুরু করে জ্ঞান অন্বেষণ। আরো আছে শেক আহমদ ওরফে শেকা। ভরা পূর্ণিমা রাতে মানুষ, পশুপাখি আর কীটপতঙ্গরা জেগে থাকে শেকার বাঁশির সুরে। ময়ূরমুখো নৌকায় চড়ে নীলাক্ষির ঘাটে ঘাটে গল্পের আসর জমিয়ে তোলেন রহস্যপুরুষ মোখেরাজ খান। দত্তপরিবার দেশান্তরি হওয়ার পর নিশিমহলে শুরু হয় সাপের বসতি। সেই কবে নিখোঁজ হওয়া অনাদি দত্ত আলখাল্লা পরে ঘুরে বেড়ান পথে-প্রান্তরে, দেখা দেন মানুষের স্বপ্নে। যৌথ বাহিনীর অভিযানের মুখে সুড়ঙ্গ পথ ধরে কি বায়ুবেলুনে চড়ে পালিয়ে যান স্বৈরশাসক কুতুব বকশি ওরফে দাদাসাব। আছে আরো অনেক চরিত্র। প্রত্যেক চরিত্রকে পূর্ণ অবয়বে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছি। বাস্তবতা ও কুহকের মিশেলে মূলত বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের সমাজ ও রাজনীতি, রক্ষণশীলতা ও উদারপন্থা, জ্ঞান ও নির্জ্ঞান এবং বহুমাত্রিক সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব নিয়ে রচিত উপন্যাস ‘উজানবাঁশি’।
একজন ঔপন্যাসিক অনেক উপন্যাস লেখেন। সবই কি তার পছন্দসই হয়ে ওঠে? শ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠে? না, কোনো কোনোটি তার অধিক পছন্দের হয়। তিনি মনে করেন, এই উপন্যাসে তিনি যা বলতে চেয়েছেন, তা ঠিকঠাক বলতে পেরেছেন। মাঝেমধ্যে কোনো কোনো পাঠক আমার কাছে জানতে চান তিনি আমার কোন উপন্যাসটি পড়বেন। তখন দ্বিধায় পড়ে যাই। কোনটির কথা বলব? রাজনটী, না বেগানা? হীরকডানা, না কালকেউটের সুখ? শেষ জাহাজের আদমেরা, না মায়ামুকুট? ‘উজানবাঁশি’ লেখার পর মনে হচ্ছে, এখন যদি কেউ আমাকে এমন প্রশ্ন করেন, আমি তাঁকে দ্বিধাহীন উত্তর দেব, ‘উজানবাঁশি’ পড়ে দেখতে পারেন। কারণ আমার কাছে মনে হচ্ছে, এ যাবৎ যে কটি উপন্যাস লিখেছি সেগুলোর মধ্যে ‘উজানবাঁশি’ শ্রেষ্ঠ। এ উপন্যাসে আমি যা বলতে চেয়েছি, ঠিকঠাক বলতে পেরেছি। যে বার্তাটা দিতে চেয়েছি, ঠিকঠাক দিতে পেরেছি। শিল্পের যে নির্মাণটা করতে চেয়েছি, ঠিকঠাকভাবে করতে পেরেছি। যদি কেউ আমার একটিমাত্র উপন্যাস পড়তে চান, তবে ‘উজানবাঁশি’র কথাই বলব।