ধূসরিমা ও অন্যান্য কবিতা

Posted: ফেব্রুয়ারি ১, ২০২১
Category: কবিতা
By:


খুঁটিনাটি

একদিন তুমি ডিমের ওপর
এঁকেছো আমার মুখ
একদিন তুমি অদ্ভুত ওরে,
হয়েছিলে উন্মুখ—

যখন রাত্রে তুষারের ওই
ধবল আস্তরণে
তাবৎ দুনিয়া পড়ে গেল ঢাকা,
তুমি বলে দিলে কানে—

‘এবার আমরা প্রকাশিত হবো
অন্য নতুন নামে’
ফায়ারপ্লেসের মতো হলে তুমি
হঠাৎ মধ্যযামে।—

তুষারের ঝড় থেমেটেমে গেছে
তুষারে দুনিয়া ভরা;
পাতাহীন গাছ তুষারের ঘায়ে
হয়েছিল আধমরা।

আমি তো ছিলাম মনমরা খুব
স্বদেশ পিছনে ফেলে
বিদেশকে তুমি যতটা পারলে
সহনীয় করে দিলে।

মনে হয়েছিল টিকে থাকা যাবে
ত্রুটিহীন চেষ্টায়;
দাঁড়াতে পারবো তুষার-মোড়ানো
প্রকৃতির জানাজায়।

স্মরণে রাখার মতোই সেসব
বলার মতো তো নয়;
লিখে রাখি তবু খুঁটিনাটি আমি
স্মৃতি নয় অক্ষয়।

সাপ

বনে-জঙ্গলে ঘুরতে আমার ভালোই লাগে
কিন্তু ঘুরি না ছোবল খাবার বিপুল ভয়ে;
র‌্যাটেল স্নেক ও কপারহেডের নাম শুনেছি
গুগল করেছি, ছবিও দেখেছি—এই সময়ে

বসন্তে যদি গাছে গাছে ফুল, ডাকছে পাখি
কার্ডিনাল ও জে বার্ড ডাকছে সারাটা দিন
জানি আমি দূর স্বদেশে আমার এখনও আছে
বসন্তকাল—কৃষ্ণচূড়ার ফুলে রঙিন।—

ফ্ল্যাট স্যান্ডেল, চেক শাড়ি পরে মেয়েরা হাঁটে
পায়ের গোড়ালি দেখা যায়, পায়ে ধুলাও লাগে
সেই দৃশ্যের গভীরে কোথাও সহজ-মতো
জীবনের এক হাতছানি বাজে ফাগুনরাগে।

বসন্তকালে বের হয়ে পড়ে সাপেরা সব,
বাংলার সাপ সবগুলি আমি চিনতে পারি।
এ-দেশি সাপের আচার-বিহার জানি না কিছু;
বসন্তরূপ ছুঁতে গিয়ে শেষে জানে না মরি।

ধূসরিমা

এই বসন্তে তোমার স্মৃতি
ডেফোডিলের ঝাড়ে হাওয়ায় উড়ে আসা
এক সাদা-কালো ছবি।

ছিল তোমার প্রেম
মাঠের সৌন্দর্যে গাছের অবদানের মতো—
দূর দেশে বসে সে-কথাই ভাবি।

অকম্পিত

প্রবাসে, বড় শহরের বাইরে জীবন আমার, প্রতিটি দিন অন্য
প্রতিটি দিনের মতো, জীবন ও মৃত্যু সমান নিরুদ্বেগে ভরে
আছে। দ্যাখো, আমার চিন্তায়, আমার কল্পনায় প্রকৃতির
সহজ প্রবেশ আমি উপভোগ করেছি। আমার চোখ এখন
চাইলেও প্রকৃতিকে ভেদ করে যেতে পারে না। হেমন্তের
বাতাস দিচ্ছে বাইরে, বৃষ্টির ছাঁটের সাথে। সবুজ পাতাগুলি কী
অবলীলায় হলুদ থেকে কমলা হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন—
তাদের এই আন্দোলনহীন বদলে যাওয়াকে আজ কিছুটা
নাড়া দিচ্ছে বৃষ্টি ও বাতাস। জানালার পাশে ঝাউয়ের
কম্পিত শরীরে আছড়ে পড়ছে সাদা সাদা গোলাপগুলি।

গাঁদা

জানি আছো অভিমানে,
তবু আছো, মাথার পিছে
উল্টে থাকা ছাতার মতো
প্রতিক্ষণে।

ভিজি আমি বিকারবিহীন—
মুরাল যেন মেঘের তলে!
যত্নে যাকে আঁকলো তোমার
রঙ ও রেখা সদলবলে।

ভাবি তোমার একাকিত্ব—
ভাবতে গেলে কেবল নিপল
কেন জানি মাথায় আসে!
দেখি আমি কী-যে চঞ্চল
নিপল যেন সদ্যোজাত
গাঁদাফুলের কুঁড়ি!
কুঁড়ির ভিতর পাপড়িগুলি
হলুদ বিভাবরী।—

ছড়িয়ে যায়, কল্পনাতে
দৃষ্টিসীমায়;
এই প্রবাসে
কোন বসন্তে ডাকছে আমায়
চাঁদের তলে!

ঘাসের স্বননে

কিছু আমি দিতে চাই, তাই কান পেতেছি আহ্বানে;
সব যোগ-বিয়োগ নিশ্চিহ্ন, শুধু ওই মুখ— প্রিয়,
কী তোমার চাই তুমি অনায়াসে আমাকে বলিও।
বসে আছি ভোরের আলোয়, মাঠে, ঘাসের স্বননে—
স্নায়ুর বাগান যেন—আন্দোলিত এই ঘাসগুলি
যেন হাওয়া নয় , আহা, আলোয় আলোয় কাঁপছে তারা।
উন্মীলনমুখরিত ওই কত সহস্র ফুলেরা
অস্তিত্বের গভীরে আমার রঙ ছড়ালো কেবলই।

ফুলেল প্রান্তর মনে হলো তোমাকে মানাবে ভালো,
কতশত হলদে প্রজাপতি ওড়ে সূর্যমুখী-ক্ষেতে;
যেইখানে সূর্যালোক ঠিকরে ওঠে বেঞ্চের ইস্পাতে
কল্পনা তোমার পাশে সেইখানে আমাকে বসালো।—
কিছু তবে পেতে চাই! — তাই কান পেতেছি আহ্বানে
বসে আছি ভোরবেলা, ছেয়ে আছি ঘাসের স্বননে।

সাব-আর্বানে শীত এলো

অর্ধেকের মতো দেয়ালজুড়ে এই কাচের জানালা। এ-পাশে
বসে সকাল থেকে কিছু লেখার চেষ্টা করছি। ও-পাশে শীত।
খয়েরি পাতা, কয়লা-কালো গাছ, কালো কান্ড, কালো শাখা,
কালো প্রশাখা। এত এত ঝরা পাতা গাছ থেকে গাছের
গোড়ায়! এত পাতা ঝরে গেল, কিছু নেই আর। সেই না-থাকা
থেকেও মন্থরতায় ঝরছে পাতা। নির্জনতা থেকে আরও
বিমর্ষতা জন্ম নিচ্ছে এই দুপুরে। তুমি কি কখনও ভেবেছি এই
সব দৃশ্য আর রঙ? দেখেছো রেমব্রান্তের আঁকা প্রতিকৃতি—
খয়েরি চুল, খয়েরি পোশাক, খয়েরি নির্জনতার নারী,
নির্জনতার নিজস্ব অন্ধকার—ভেবেছো?—যেন সেই নারী,
তার পার্রিপার্শ্বিক সব ষড়যন্ত্র, সব কোলাহল কালো জলের
মতো, শান্ত হয়ে এসেছে। কেবল সে মুদে আছে জলের ওপর
একটি অনামা ফুলের মতো।— ভাষা কেড়ে নেয়। এ-বেলা কী
করে কিছু লেখা সম্ভব বিশাল জানালার এপাশে বসে!

মনস্তাপে

লোহার চেয়ার পাতা আছে মরা উইলো গাছের তলে
প্যান্ডামিকের কাল কাটে সাব-আর্বান অঞ্চলে।
শীতকাল এসে ভেঙে দিলো যদি দৃষ্টির পরিসীমা;
কাঙ্গাল কালো বনের পিছনে সূর্যের রক্তিমা
ওই দেখা যায়। —আগুন যেনবা কয়লার পশ্চাতে!
খবর পেলাম, সাদা হবে সব, তুষার ঝরবে রাতে।
যদি কোনো ভাবে তুমি এসে যেতে এ দূর প্রবাসে;
উইলো শাখারা মরে ভূত হলো, ঘাসেরা মরলো মাঠে
মরা ডালপালা কেঁপে ওঠে শুধু গেরুয়া বাতাসে।
তোমার সঙ্গে দেখা হয় যদি¬ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে—
এতদিনকার দূরত্ব! —কত কিছু-যে বদলে গেছে! —
এত দূর থেকে যায় কি তা বোঝা, দেখে মনে হয় ঘন;
ফাঁকগুলি মেনে নিতে পারবো কি যদি চলে আসো কাছে
উষ্ণতা ভুলে উইলোর মতো হয়ে যাবো থমকানো?
তোমাকেই ভালোবাসি নাকি আমি এত এত দিন পরও
প্রশ্ন থাকেই, প্যান্ডামিক আর অভিযোজনের চাপে
তোমাকেই ঘিরে ডুবে গেছি যেন খামাখা মনস্তাপে।
দিন বদলালে স্বাভাবিকতায় হবো কি উত্তরিত?

কুপার নদী

কুপার নদী এতই সরু, লাফিয়ে পার হবেই গরু, মানুষ এবং
হরিণ। আসলো এমন দিন! —মরা সাপের মতো নদী, সময়
মিলে একটু যদি, পাড়ে এসে বসি। নদী তো নয়, রশি! গাছ
যদিবা হওয়ায় নড়ে, দুই-এক দফা পাতা ঝরে। আমার কি
আর এতেই চলে! পারলে আমি ছলে-বলে দেশেই ফিরে
যাই। লিবিডো দেয় ঘাই তাহার কথা মনে হলে— জানি না সে
কী যে বলে নিজের মনে একা একা। সারা হলো আমার
দেখা— প্রবাস মানেই ছাই, আর তো কিছু নাই।

শীত

হরিণ মরেছে মেইল বক্সের পাশে
পাতাহীন ওক গাছে কয়েকটি ভলচার
হিমেল হাওয়ার কাল, ফেব্রুয়ারি মাসে
মরা হরিণের গায়ে ঝরছে তুষার।

কী করে হরিণগুলি এমন ঠান্ডায়!
সিডার ব্যাতীত আর সব গাছ শূন্য
সারাদিন চলে যায় খাবার খোঁজায়—
সিডারের পাতা শুধু, খাবার সামান্য।

দুর্গন্ধ আসে না নাকে মরা হরিণের;
সযতনে দিচ্ছে শীত গন্ধকে থামিয়ে!
বের হয়ে আসবে তার কাঠামো হাড়ের
স্প্রিং দেবে হাড়ে ফুল বৃন্তকে মুড়িয়ে ।

শীত ছাড়া আর কিছু দেখিনি এখনও:
পেয়েছি সূর্যের তলে হিমেল বাতাস
আকাশ এতটা নীল—ভাবিনি কখনও;
মৃত্যুর ওপর যেন নীল অবভাস।

কী করবো বুঝি না কিছু, ভালো তো লাগে না
ধৈর্য্যহারা হব নাকি? হব না এখনই;
হাওয়া-পানি, কাল আর আমার ভাবনা—
তাবৎ প্রবাহ জুড়ে শীতের শাসানি।


আল ইমরান সিদ্দিকী

জন্ম: অক্টোবর, ১৯৮৩ ইং, নীলফামারি।
বর্তমান নিবাস: নিউ জার্সি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর করছেন রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে।

প্রকাশিত কবিতার বই:
কাঠঠোকরার ঘরদোর (২০১৫)
ধুপছায়াকাল (২০১৮),
গোধূলির প্যানোরামা (২০২০)।

সম্পাদনা : ওয়েবম্যাগ নকটার্ন  (যৌথ)।

শেয়ার করুন

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts

Begin typing your search term above and press enter to search. Press ESC to cancel.

Back To Top
error: Content is protected !!