একটা খুশির দিন

Posted: ফেব্রুয়ারি ১, ২০২১
Category: গল্প
By:


মতিন শেখের খুশির সীমা নাই।

পুনর্ভবার পানি নামতে শুরু করেছে। সেই পানিতে মতিন শেখ বোয়াল ধরেছে। ওজনের পর দেখা গেল সাড়ে সাত কেজিতে পঁচিশ গ্রাম কম। অহিদ জামান নগদ তেরশ টাকায় কিনে নিলো মাছটা।

কিন্তু মতিন শেখ ঠিক এই কারণে যে খুশি তা না, তার খুশির অন্য কারণ আছে।

ব্যাপার হলো মিষ্টি। নান্টু ঘোষের চমচম। মতিন শেখ দুই কেজি তিন কেজি করে পাঁচ কেজি কিনল। নান্টু ঘোষ বলল, এত মিষ্টি কী করবা জি শ্যাখ?
মতিন বলল, মাইয়াটার খুব পছন্দ না জি তুমার চমচম?

ঠিকা অটোই নিলো মতিন। মাছ সে আবার ধরবে। বাসে উঠলে দিরুম হয়... সকাল সকাল গেলে জামাইটা থাকব ঘরে। পাঁচ কেজি চমচমেও কি মন উঠব না তার?

পাঁচ বছরেও ওঠেনি অবশ্য।

জামাই তার মাস্টার। এই নিয়ে মতিন শেখের গর্ব যদি হয়, এই জন্যই কিনা কে জানে, ছাত্রের বেত মেয়ের ওপরেও বর্তানো ফরজজ্ঞান করে সে।

মেয়েটা এইদিকে আবার একটু অভিমানীও। ফিচফাচ কান্দে। ফোন দেয় আকলিমার ফোনে। বলে, আব্বা, তুমি আমারে নিয়া যাও।

মতিন শেখ চুপ। চুপ না তো কি? অত সাহস অত গ্যাঁটের জোর আছে নাকি তার!
কণ্ঠে তাই সমঝোতা— মানাই নিবি না…
কখনো কখনো ঝাঁজও— এই রকম সবখানেতেই হয়। তর মায়ের সাথেও আমার বিবাদ হইত না, দেখোস নাই?

মেয়ে যে খুব দেখছে তা অবশ্য না। মরছে মা সেই কবেও।

আকলিমা ফোনের জন্য ডাকলে মতিন শেখ তাই একটু ভড়কে যায়। আবার কী হলো কে জানে?

শেষবার মেয়ে ফোন দিলো দিনে দিনে তেরো দিন আগে। বলল, আব্বা তুমি আসবা না?
'আসবো তো। কাজকাম সাইরা নিয়াই আইসা পড়ব।'
'এখন তুমার কাজ কী? ধান কাটাও তো শ্যাষ।'
'আরে, আছে না.. কাজকাম!'

বলে মতিন শেখ ঠিকই, কিন্তু কোনো কাজের নামও সাধতে পারে না। মেয়ে গাল ফোলায়— বুঝছি তুমি আসতে চাও না আমার দাওয়ায়...
'না না। যামু যামু। যামু রে।'
'কবে আসবা কও?'
'সামনের সপ্তায় যামু!'
'সত্যি কইতেছ তো? আব্বা, তুমি ঘোষ চাচার মিষ্টি আনবা কয়টা?'
'চমচম?'
'পারলে আইনো আব্বা… এরা সেইদিন কালোজাম আনছিল…'
'খাইতে ভালা না, না?'
'কী জানি। আমারে খাইতেই দেয় নাই।'
'না দিক। ওই সব মিঠাই ভালা না রে। আমি নান্টু ঘোষের চমচম আনমু নে… দেখিস… সবাইরে দিয়া খাইবি। তর শ্বশুরবাড়ি অন্য সব মিষ্টির নাম ভুইলা যাইব।'
'আর যদি না পারো, তাইলে খালি তুমিই আইসো, আব্বা। তুমারে দেখি না কদ্দিন?'

মতিন শেখ চোখ মোছে। অটো ড্রাইভার বলে, এই দিকে ধুলা বেশি। চোখ ঢাইকা বসেন জি চাচা...

২.
কাঁচা রাস্তার মাথা পর্যন্ত অটোটা যায়। তারপর বেশ খানিকটা হাঁটাপথ। মিষ্টি নিয়ে জামাইয়ের বাড়ির দিকে হাঁটতে মতিন শেখের ভাঙাচোরা বুকটাও কেমন ছাতি হয়ে ওঠে। পুকুরটাকে ডানে রেখে মাটির দেয়াল ঘেরা বাড়ি। বাড়ির পিছনে এক জঙ্গল কলা গাছ। মতিন শেখ কাশি দিয়ে ঢুকতেই দেখে উঠানে বিস্তর লোকের সমাগম। ভেতর থেকে হইহট্টা। কেউ একজন চিৎকার করছে— হারামির বেটি হারামি... মরার আর টাইম পায় নাই... শুয়ারের আভারুত একটা!

মতিন শেখ পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় ঘরের দিকে। কড়িকাঠ থেকে একটা শাড়ি ঝুলছে। শাড়ির আঁচলে ঝুলছে তার মেয়ে। মুখটা তার শান্ত। যেন ঘুমাচ্ছে।

একজন বলে, হারামির পয়দার খোমা দেখছ? ফাঁস দিছে কিন্তু জিবটাও বাইর হয় নাই…

মেয়েটাকে ধরাধরি করে উঠানে নামানো হয়। মাটির ওপর শরীরটা শোয়ায়ে দিলে মতিন শেখ থমকে তাকিয়ে থাকে। তখনই জামাই বলে, মাইয়া মরতে ঘণ্টাও যায় নাই আর আপনে কুত্তার লাখান শুঁইকা আইসা পড়ছেন?

মতিন শেখের লজ্জাই হয়। এত দ্রুত আসা তার উচিত হয় নাই। বিকালের দিকেও যদি আসত, মরার খবরটা অন্তত নিয়ে আসতে পারত। সেই সংকোচেই কিনা, মতিন শেখ মেয়ের পাশেই, মাটিতেই, বসে পড়ে। মুখটা মেয়ের খোলা পড়ে আছে। যা হাত দাওয়ার হয়ে গেছে দেওয়া, বাকিটা পুলিশের। জামাই থুক ফেলে সশব্দে— সাওয়ার জীবন রে!

মতিন শেখেরও খারাপ লাগে। পুরা বাড়িটায় এত মানুষ, এইগুলারে সামলানোটাও তো মুশকিল। মেয়েটা মরে বাড়ির সবাইরে একটা বিপদে যে ফেলছে এইটা সত্য। তার ননদটা মুখে লিপস্টিক দিয়ে স্কুল যাওয়ার জন্য তৈরি ছিল। এখন যেতে পারছে না। জামাইয়ের ক্লাস তো ছিল... শাশুড়ি অবশ্য পান মুখে দিয়েছে। কিন্তু তাও, এই সবের মধ্যে, পান চাবাবেই বা কীভাবে?

পুলিশ আসে আরও ঘণ্টা দুয়েক পর। একটা মটোর সাইকেল। তিনটা পুলিশ। মাঝের জন হেড। ফলে চোখে কালো চশমা।

: আপনের মাইয়া?
: জি।
: নাম কী?
: জি পাখি।
: পুরা নাম কন চাচা...

পুরা নাম মনে করতে পারে না মতিন শেখ। জামাই বলে, মোসাম্মাত পাখি বেগম।

পুলিশ নাম ঠিকানা লেখে।

: কদ্দিন বিয়া দিছেন মাইয়ার?
: আষাঢ় আইলে ছয় বচ্ছর।
: সুইসাইড খাইল ক্যান?

ক্যান যে খাইল বলতে পারে না মতিন শেখ। জামাই বলে, মাথায় ছিট ছিল। ছিটাল বেটি। ভর রাইতে একলা একলা কানত...

পুলিশ নোট নিতে থাকে— আর এইগুলা, এইগুলা কী?

মতিন শেখ মিষ্টি নিয়াই বসা। আস্তে করে বলে, চমচম।

: মাইয়া মরার খবর পায়া মিষ্টি নিয়া আসছেন নাকি?

পুলিশের এই কথায় সারা উঠান হা হা করে হেসে ওঠে। মতিন শেখের সংকোচ আরও বাড়ে৷ সকাল সকাল আসা একদমই ঠিক হয় নাই। মরার খবর পাওয়ার পর আসা উচিত ছিল!

জামাই বলে, পুরা ফ্যামিলি ছিটাহি। নাইলে মাইয়া ফাঁস দিলে বাপে মিষ্টি আনে?

কথা সত্য।

উঠানের সবাই এই কথায় তেমন কিছু না বলেই সম্মতি দেয়। পুলিশও দেয়। ফলে, মোসাম্মাত পাখি বেগমের শরীরে কাফন ওঠে। গোর খুঁড়তে যায় তিনজন। পুকুরপাড়।

বেলা আসরে গড়ায়। উঠানে লোকজন আরও বাড়ে। অপঘাতের মরায় কৌতুহলের শেষ নাই। লাশ উঠানো হয়। গোর রেডি। কেউ একজন কয়টা আগরবাতিও জ্বালায়। জামাই বলে, একটা পুরা দিন বাল মাটি!

মতিন শেখের কী জানি হয়। মিষ্টির প্যাকেট হঠাৎই খুলে ফেলে। একটা একটা করে মিষ্টি উঠানের সবাইকে দিতে থাকে মানত মানা সিন্নির মতো করে। বড় চমচম... নেবো কি নেবো না করেও সবাই নেয়। কেউ কেউ বলে, মরার বাড়িতে মিষ্টি আবার খাই ক্যামনে?

কিন্তু সবাই খায়। নান্টু ঘোষের সুনাম করে সবাই। জামাই বলে, আবার কি ছিট তুলছেন নাকি মাথায়? এহন মিষ্টি খাওনের সময়?

মতিন শেখ বলে, মাইয়া মরার খুশিতে খাওয়াই বাবাজি। তুমিও খাও। এমন খুশির দিন আমার মাইয়াটার জীবনে আর আসে নাই!


আহমেদ খান হীরক

জন্ম ৮ নভেম্বর ১৯৮১। দশ বছরের লেখালেখির জীবনে লিখছেন মূলত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়।
বর্তমানে কর্মরত একটি বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলে।

প্রকাশিত গ্রন্থ
কবিতা :আত্মহননের পূর্বপাঠ (২০১০)
রম্য সংকলন : যে কারণে আমি সাকিব আল হাসান হতে পারি নি (২০১৭)
গল্প সংকলন : য পলায়তি স জীবতি (২০২০), সিলগালা মহল্লার ব্যালকনিরা (২০২১)

শেয়ার করুন

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Posts

Begin typing your search term above and press enter to search. Press ESC to cancel.

Back To Top
error: Content is protected !!